অভিযোগ বহু, তবু বরাবরই দাপুটে মন্টুরাম

২০০১-এ বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের টিকিটে জিতে আসার আগে তাঁর নাম-টাম তেমন শোনা যেত না। তৎকালীন শাসকদলের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সহবস্থান’-এ বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তাই অন্যের জমি দখলের মতো নানা অভিযোগে জড়িয়েও দিব্য ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৩
Share:

২০০১-এ বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের টিকিটে জিতে আসার আগে তাঁর নাম-টাম তেমন শোনা যেত না। তৎকালীন শাসকদলের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সহবস্থান’-এ বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।

Advertisement

তাই অন্যের জমি দখলের মতো নানা অভিযোগে জড়িয়েও দিব্য ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরা। ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটে শিকে না-ছিঁড়লেও গায়ে আঁচ লাগেনি। কারণ বামফ্রন্ট সরকারের সর্বস্তরের সঙ্গে তাঁর তখনও দুর্দান্ত দহরম-মহরম! ২০১১-য় ‘মমতা হাওয়া’র ভরে ফের বিধায়ক হয়ে এসেই মন্টুরামের প্রতিপত্তি তুঙ্গে ওঠে।

এবং দু’বছর বাদে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের ভার পেয়ে তিনি রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন বলে অভিযোগ। জেলা তৃণমূলের অন্দরেও এ নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ। সুন্দরবনের এক পুরনো তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘ভিজে বেড়াল মন্টু পাখিরা ২০১১-র ভোটে জিতে এসে বাঘ হয়ে গিয়েছেন। মন্ত্রী হওয়া ইস্তক শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছেন জলে-জঙ্গলে। সব দখল করছেন!’’

Advertisement

কাকদ্বীপে পা রাখলেই মন্টুবাবুর বিরুদ্ধে নানা কথা কানে আসে। এক তৃণমূল নেতাই জানিয়েছেন, প্রথম বার বিধায়ক হওয়ার পরে একাধিক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ উঠেছিল মন্টুরাম ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে। কাকদ্বীপ শহর এলাকায় এক রেশন ডিলারের জমি দখলের ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছিল। থানা-পুলিশ হলেও তাঁকে পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হয়নি কখনও।

দলীয় সূত্রের খবর: ২০১১-তেই সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে মন্টুরামের নাম উঠেছিল। সে বার তাঁর কপালে মন্ত্রিত্ব না-জুটলেও নিজের তল্লাটে ‘রাজ্যপাট’ কায়েম করতে অসুবিধে হয়নি। ২০১২-য় কাকদ্বীপের দক্ষিণ গোবিন্দপুরে একটি আশ্রমের ৫৬ শতক জমি দখল-কাণ্ডে তাঁর নাম জড়ায়। অভিযোগ ওঠে, দেড় কোটি টাকার জমি বিধায়ক কব্জা করেছেন স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে। এর জল আদালেত গড়িয়েছে। ‘‘এখানে তৃণমূলের মধ্যে সিন্ডিকেটের লড়াই নেই। মন্টুরাম-ই এখানে একমাত্র সিন্ডিকেট।’’— কটাক্ষ করেছেন স্থানীয় এক সিপিএম নেতা।

মন্টুরামের মন্ত্রী-ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে ২০১৩-য়। দুর্নীতির অভিযোগের জেরে শ্যামল মণ্ডলকে সরিয়ে মন্টুরামকে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাকদ্বীপের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তামাম সুন্দরবন জুড়ে মন্টু-গোষ্ঠীর রমরমা শুরু হয়। যে সব অভিযোগে শ্যামল মণ্ডলকে সরানো হয়েছিল, তেমনই বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে থাকে মন্টুরামের বিরুদ্ধে।

যেমন, বাম আমলে অর্ধনির্মিত থাকা গোসাবা যুব আবাসন এখনও তৈরি না-হওয়া। দফতরের এক অফিসার বলেন, ‘‘বাম জমানার ঠিকাদারকে সরিয়ে নিজের লোকজনকে বরাত পাইয়ে দেওয়ার জন্য মন্ত্রী নিজেই নানা আইনি জটিলতা সৃষ্টি করেছেন। ফলে কাজ পিছিয়ে গিয়েছে।’’ শেষমেশ আগের ঠিকাদারকে সরিয়ে মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠকেই বরাত দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

এ নিয়েও মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। অপসারিত ঠিকাদার ক্ষতিপূরণের দাবিতে হাইকোর্টে গিয়েছেন। ব্যাপারটা নবান্নের নজরেও এসেছে। কিন্তু মন্টুরামের গায়ে আঁচড়টি পড়েনি। সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন বসতি অঞ্চলে টিউবওয়েল বসানো ঘিরেও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দফতরের খবর, দলেরই একাধিক বিধায়ক মন্টুবাবুর বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন, যার সত্যতা ধরা পড়েছে বিভাগীয় অডিটে।

মন্টুবাবু অবশ্য নির্বিকার। বরং যাবতীয় অভিযোগ তিনি ফুৎকারে ওড়াচ্ছেন। ‘‘আমি অবিবাহিত। পিছুটান নেই। খুব সাধারণ জীবনযাপন করি।’’— বুধবার বলেছেন তিনি। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘আমার গায়ে কালি মাখাতে দফতরের কিছু অফিসার ষড় করছেন। আমি সব কিছু মুখ্যমন্ত্রীকে জানাব।’’

ওঁর কথা নিছক আস্ফালন নয়, তারও ইঙ্গিত মিলেছে। প্রশাসন ও তৃণমূল-সূত্রের খবর: বন কেটে অবৈধ রাস্তা নির্মাণ বা ম্যানগ্রোভের জঙ্গল ধ্বংসের বিবিধ প্রমাণ মজুত থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদের হাত ওঁর মাথা থেকে সরেনি। সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের এক সদস্যের পর্যবেক্ষণ, ‘‘খোদ সচিবের বদলিই বুঝিয়ে দিল, মন্টুরামের হাত কত লম্বা!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন