শান্তিনিকেতনে প্রতীচীর অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেন। নিজস্ব চিত্র
স্বাস্থ্য পরিচর্যার উন্নতিতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্মীদের ভূমিকার উপরে আরও এক বার জোর দিলেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
শুক্রবার শান্তিনিকেতনের বনিয়াদে প্রতীচী ট্রাস্ট আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য পরিচর্যার উন্নতিতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কর্মীদের ভূমিকা’ বিষয়ক দুদিনের আলোচনা সভার শেষ দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মাণ ভারত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন অমর্ত্যবাবু। ২২ মিনিটের বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার থেকে যা হচ্ছে তার বহু জিনিস লোক দেখানো, কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য হচ্ছে। আমাদের সমস্যাগুলির বিষয়ে আমাদেরকে আগে জানতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য চর্চা করতে গেলে শুধু টাকা হাতে এলো তাতেই নয়, ব্যবস্থাপনাও দরকার। ব্যবস্থাপনার সঙ্কীর্ণতা আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় দেখা যাবে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভীষণ রকমের অবহেলা রয়েছে। খুব কঠিন রোগের চিকিৎসা নিয়ে বহু মানুষ প্রচুর টাকা খরচ করেন, তাঁদের টাকা যাচ্ছে তার ফলে প্রাথমিক চিকিৎসা কম হচ্ছে তা নয়।’’
তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রাথমিক চিকিৎসায় যে অবহেলা রয়েছে সেটা মানুষ ততটা দেখতে পাচ্ছে না, তার কারণ নানা দিক দিয়ে মনে হচ্ছে সরকার বহু জিনিস করছে। যেমন রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা, আয়ুষ্মাণ নামে একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পে জোরটা কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসার দিকে নয়। একদিকে অবহেলাটা প্রাথমিক চিকিৎসার দিকে, সমাধানটা হচ্ছে অপ্রাথমিক চিকিৎসার দিকে। কেন্দ্রীয় সরকার সাম্প্রতিক বাজেটে আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমা যোজনায় প্রায় ৫০ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এর ফলে প্রায় ১০ কোটি পরিবার উপকৃত হবে। ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা পাবে প্রতিটি পরিবার। সারা দেশের যে কোনও প্রান্তেই এই বিমার সুবিধা মিলবে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তির আগে ওই সংক্রান্ত অসুস্থতায় আগের এবং পরের খরচও দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।
যদিও আলোচনা সভা শেষে অমর্ত্যবাবু নিজের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার সব কিছুই কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য করছেন এই রকম আমি বলছি না, বহু জিনিস করছেন যেগুলোতে টাকা যা ব্যায় হচ্ছে তার তুলনায় সাধারণ লোকের জীবনযাপনে উন্নতি হওয়া সম্ভব হলেও ততটা হবে না বলে আমি মনে করি। যেমন আমাদের দেখতে হবে, প্রধান সমস্যা কি কি রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় রকম অভাব রয়েছে। আয়ুষ্মাণ প্রকল্পে কত টাকা যাবে, আইএসডিআইয়ে কত টাকা যাবে, সেই সমস্ত বিষয়গুলি দেখা দরকার। এখনও বহু জায়গায় মানুষ ইমুনাইজেশন পান না। টিকা পান না। পুষ্টির অভাব রয়েছে। এই অভাবগুলো এখনও রয়ে গিয়েছে, সেগুলো দূর করা দরকার। আয়ুষ্মান প্রকল্পের জন্য যে টাকা ব্যবহার হচ্ছে সেই টাকা ব্যবহার করে চিকিৎসার উন্নতিতে যা করণীয় সেগুলো হচ্ছে কি না দেখা দরকার। প্রাথমিক চিকিৎসায় উন্নতি সম্ভব যেভাবে সেগুলো করা হচ্ছে কি? সেগুলো আগে দেখা দরকার। আয়ুষ্মাণও হল না, অন্য কিছুও হল না তাতে কি আমরা লাভবান হব? যে অর্থ চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে, সেই অর্থটা এর থেকে ভাল ভাবে ব্যবহার করা যায় কি? আমার মনে হয়, আয়ুষ্মাণ পশ্চিমবঙ্গে ভালভাবে করা যেতে পারে।’’ স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর উপর বারবারই সোচ্চার হয়েছেন তিনি। এ দিনও বলেন, ‘‘শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যতটা অর্থ ব্যায় করা উচিৎ ছিল তার কাছাকাছিও হচ্ছে না।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শিক্ষাদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘৬৩ বছর ধরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি পাশাপাশি সেই সময়কার একাধিক স্কুল চালানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। চিন এবং বাংলাদেশ যতটা এগোতে পারছে আমরা কেন পারছি না? চিনের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। চিনের অর্থনৈতিক প্রগতি অনেক হয়েছে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। টেলিফোন, কলম, আলপিন এই সব জিনিস চিন অত্যন্ত সহজে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য।’’
দুদিনের আলোচনায় রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা যোগ দেন।