Amit Shah Mamata

শাহ-মমতা নারদ নারদ! পাঁচটি অমিত-অভিযোগ ধরে ধরে কড়া জবাব দিদির, ‘ভাইপো খোঁচা’র পাল্টা হাতিয়ার হলেন ‘পুত্র’ জয়

তৃণমূলের ‘স্বরূপ উন্মোচনে’ অমিত শাহ অনুপ্রবেশ, জমি, দুর্নীতির দায়ে নেতা-মন্ত্রীদের জেলে যাওয়া, তোষণ এবং বিধানসভা নির্বাচনে আসন জেতা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। বাঁকুড়ার বড়জোড়ার সভা থেকে মমতা ধরে ধরে প্রতিটি বিষয়ের জবাব দিয়েছেন। সঙ্গে পাল্টা প্রশ্নও তুলেছেন বিজেপি তথা শাহের বিরুদ্ধে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৫
Share:

(বাঁ দিকে) মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে অমিত শাহ, বাঁকুড়ার জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। ব্যবধান ৩০ মিনিটের। মঙ্গলবার এই দূরত্ব এবং এই সময়ের ব্যবধানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ দেখল রাজ্য রাজনীতি। যা থেকে স্পষ্ট যে, বছরের শেষে দু’পক্ষই নতুন বছরে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন।

Advertisement

সল্টলেকের বিজেপি দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করে পাঁচটি বিষয়ে মমতার সরকারকে তুলোধনা করেছিলেন শাহ। তাঁর সাংবাদিক বৈঠক শেষ হওয়ার ৩০ মিনিট পরে বাঁকুড়ার বড়জোড়ার সভামঞ্চ থেকে অভিযোগ ধরে ধরে শাহকে পাল্টা জবাব দিয়েছেন মমতা। সে সঙ্গে হুঁশিয়ারির সুরে এ-ও বলে রেখেছেন যে, তৃণমূল ‘সৌজন্যের রাজনীতি’ করে বলে শাহ তাঁর কলকাতার হোটেলের বাইরে বার হতে পেরেছেন। নইলে এক পা-ও এগোতে পারতেন না! মমতার বক্তব্য, শাহকে ‘তালকুটিরে’ বসে থাকতে হত। প্রসঙ্গত, এ বার কলকাতা সফরে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিউটাউনের ইকো পার্কের লাগোয়া ওই হোটেলেই উঠেছেন।

তৃণমূলের ‘স্বরূপ উন্মোচনে’ শাহ অনুপ্রবেশ, জমি, দুর্নীতির দায়ে নেতা-মন্ত্রীদের জেলে যাওয়া, তোষণ এবং বিধানসভা নির্বাচনে আসন জেতা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর সভা থেকে মমতা ধরে ধরে সেই বিষয়গুলির কড়া জবাব দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পাল্টা প্রশ্নও তুলেছেন বিজেপি তথা শাহের বিরুদ্ধে।

Advertisement

১. অনুপ্রবেশ

শাহ: পশ্চিমবাংলার সীমান্ত দিয়ে যে অনুপ্রবেশ হচ্ছে, তা শুধু বাংলার বিষয় নয়। পুরো দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্ন। এমন মজবুত সরকার এখানে আনুন, যারা এখানে অনুপ্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে।

মমতা: অনুপ্রবেশ কি খালি এই রাজ্যের বিষয়? কা‌শ্মীরে অনুপ্রবেশ হয় না? তা হলে পহেলগাঁওয়ের ঘটনা কি আপনারা ঘটিয়েছেন? দিল্লির ঘটনা (লালকেল্লার সামনে বিস্ফোরণ) কি আপনারা করিয়েছেন? সাকেত যখন আরটিআই করেছিল (তথ্য জানার অধিকার আইনে প্রশ্ন করে তথ্য-পরিসংখ্যান পেয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাকেত গোখলে), তখন দেশের সরকার জানিয়েছিল ১৪০ কোটি আধার কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে ১১ হাজার অনুপ্রবেশকারী। সংখ্যাটা এতটাই নগণ্য!

২. জমি

শাহ: ভারত সরকার পুরো দেশে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে। সব জায়গায় পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে কেন আটকাচ্ছে? তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানায় কেন সমস‍্যা হচ্ছে না? অখিলেশ যাদব মুখ‍্যমন্ত্রী থাকাকালীন কেন উত্তরপ্রদেশেও সমস্যা হয়নি? সাতটা চিঠি লিখেছি মমতা’জিকে। গত ছ’বছরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব তিন বার পশ্চিমবঙ্গে এসে বৈঠক করেছেন। তার পরেও তৃণমূলের সরকার কেন জমি দিচ্ছে না?

মমতা: এখানে এসে দুঃশাসনবাবু (অমিত শাহকে দেওয়া মমতার নতুন নাম) এসে বলছেন, মমতা’জি জমি দেননি! জমি না-দিলে তারকেশ্বর-বাঁকুড়া রেলপথ হল কী ভাবে? কী ভাবে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোলে ইসিএল কাজ করছে? অন্ডালে বিমানবন্দরের জমি কারা দিয়েছে? মিথ্যা কথা বলার একটা সীমা থাকে! বনগাঁ, পেট্রাপোল, ঘোকসাডাঙায় আমরাই জমি দিয়েছি। আমি বিএসএফের বিরুদ্ধে নই। আগে যে জমি দিয়েছি, সেগুলোয় কাজ শেষ করুন। ওগুলো কেন ফেলে রেখেছেন? কাজ করুন, তার পর আবার দেব।

৩. দুর্নীতি এবং নেতাদের জেলযাত্রা

শাহ: দুর্নীতিতে গোটা বাংলার জনতা ত্রস্ত। রোজভ্যালি চিটফান্ড, ক্যাশ ফর কোয়্যারি (তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ), এসএসসি, পুরনিয়োগ, গরুপাচার, রেশন, ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দুর্নীতি— এত দুর্নীতি রয়েছে পুরো তালিকা বলতে গেলে আমার পুরো সাংবাদিক বৈঠকই তাতে কেটে যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি উত্তর দিতে পারবেন? আপনার মন্ত্রীর ঠিকানা থেকে ২৭ কোটি টাকা পাওয়া যায়। যা গুনতে গুনতে নোট গোনার মেশিনও গরম হয়ে যায়। বাংলার মতো গরিব রাজ্য থেকে ২৭ কোটি, ২০ কোটি, ১৫ কোটি করে টাকা পাওয়া যাচ্ছে। আপনার কোনও দায় নেই? পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অনুব্রত মণ্ডল, জীবনকৃষ্ণ সাহা, মানিক ভট্টাচার্য, চন্দ্রনাথ সিংহ, পরেশ পাল (চন্দ্রনাথ, পরেশ পাল কোনও মামলায় জেলে যাননি। পরেশ পালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও মামলাও নেই), কুন্তল ঘোষেরা জেলে যান। ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের অভিযুক্ত বলা হয়। কুণাল ঘোষ তিন বছর জেলে কাটিয়ে আসেন। আর আপনি বলছেন দুর্নীতি হচ্ছে না! আপনি চোখ বন্ধ করে আছেন। কিন্তু বাংলার জনতা চোখ বন্ধ করে বসে নেই। পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে, ভাইপো একাই সব কামাবে। আর কেউ কিছু করতে পারবে না।

মমতা: আরে, আমাদের লোকেরা দুর্নীতি করলে ব্যবস্থা নাও! আমাদের তো চার জনকে ধরেছিলে। জেলে রাখতে পেরেছ? পারোনি। আর তোমাদের খুন-ধর্ষণ করা লোককে ছেড়ে দিচ্ছ। তোমাদের চৌবাচ্চারা সব লেপের তলায় ঢুকে রয়েছে। খালি বড় বড় কথা। বলে পরিবারতন্ত্র করি না! তা হলে আপনার ছেলে কী ভাবে আন্তর্জাতিক স্পোর্টসের (আইসিসি) চেয়ারম্যান হলেন। ওখান থেকে কোটি কোটি টাকা কামাবে বলে?

৪. তোষণ

শাহ: এতদিন ধরে তোষণের রাজনীতি করে এখন মলম লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে দেখছি। কোনও মলম আর কাজ করবে না।

মমতা: ওরা মাতঙ্গিনী হাজরাকে মুসলিম বলে দিচ্ছে। আমাকে তো সারা ক্ষণ বলে! ওদের যা খুশি বলুক। আমায় তফসিলি, আদিবাসী যা ইচ্ছে বলতে পারেন। আমি মানুষের জন্য কাজ করার জন্য জন্মেছি। আজীবন সব ধর্মের সব মানুষের জন্য করে যাব।

৫. ভোটের আসন

শাহ: এ বার যে বাংলায় বিজেপির সরকার হবে, তা মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়েই বলছি। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক যাত্রাটা দেখুন। ২০১৪ সালে ১৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১০ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৪১ শতাংশ ভোট আর ১৮ আসন, ২০২১ সালে ৩৮ শতাংশ ভোট আর ৭৭ আসন পেয়েছিলাম। ২০২৪ সালের ভোটে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ১২টি আসনে জিতেছে বিজেপি। ২০২৬ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ব।

মমতা: আগের বার বলেছিল, ‘ইস্ বার, দোসো (দুশো) পার’। হয়ে গেছিল পগারপার। এ বার বলছে দুই-তৃতীয়াংশ। আমি বলি, আগের বার কচু পেয়েছিলে। এ বার ঘেঁচু পাবে। ঘেঁচু মানে বোঝো? ঘেঁচুর ইংরেজিটা যেন কী?

বস্তুত, শাহের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীরা বিষয় ধরে ধরে একাধিক ভাষায় জবাব দেওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু মমতা একই সঙ্গে যে পাঁচটি বিষয়ে শাহ আক্রমণ করেছিলেন, একাধারে তার সবক’টিরই জবাব দিয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, শাহের উপর মমতা বহুদিন ধরেই ‘খড়্গহস্ত’। বরাবর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কড়া ভাষায় শাহকে আক্রমণ করেছেন। মঙ্গলবারেও তিনি সেই ‘রণং দেহি’ মেজাজেই ছিলেন। এখন দেখার, বুধবার, পশ্চিমবঙ্গে সফরের দ্বিতীয় দিনে শাহ আবার মমতার পাল্টা কিছু বলেন কি না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement