গাড়ির নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার নালিশ

চুমকিদের নিয়েই যায়নি নিশ্চয় যান

হাসপাতালের খাতায় নথিভুক্ত নম্বরটি ‘নিশ্চয় যানে’রই। অথচ অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডের তপন লেট যে গাড়িতে চড়েছিলেন, সেটি একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্স!বর্ধমানের নার্সিংহোম-কাণ্ডে সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের এমনই একটি দুষ্টচক্রের দিকটিও সামনে এসে গেল।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৪৮
Share:

রোগী সহায়তা কেন্দ্রের সামনে চালকদের জটলা।নিজস্ব চিত্র।

হাসপাতালের খাতায় নথিভুক্ত নম্বরটি ‘নিশ্চয় যানে’রই। অথচ অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডের তপন লেট যে গাড়িতে চড়েছিলেন, সেটি একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্স!

Advertisement

বর্ধমানের নার্সিংহোম-কাণ্ডে সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের এমনই একটি দুষ্টচক্রের দিকটিও সামনে এসে গেল।

অভিযোগ, বিপর্যস্ত পরিজনদের ভুল বুঝিয়ে হাসপাতাল থেকে এ ভাবেই রোগীদের নিয়ে চলে যায় চালকেরা। একশ্রেণির কর্মীদের সঙ্গে যোগসাজস করে তারা হাসপাতালের রোগী সহায়তা কেন্দ্রে নিশ্চয় যানের নম্বর দেখিয়ে রোগীদের তুলে নিয়ে যায় পছন্দের নার্সিংহোমে। বিনিময়ে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চালকেরা পান মোটা কমিশন। রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসছে। আর তপনবাবুদের এই চক্রের পাল্লায় পড়ার নেপথ্যেই উঠে আসছে সরকারি হাসপাতালের পুরনো রেফার রোগের বেহাল ছবিটিও।

Advertisement

হাসপাতালের রেকর্ড বলছে, খিঁচুনি ও মাথাব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া চুমকি লেটকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হাসপাতালের সিসিইউ থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। প্রসূতি হওয়ায় নিয়ম মাফিক একটি নিশ্চয় যানও বরাদ্দ করা হয়। হাসপাতালের রোগী সহায়তা কেন্দ্রের খাতায় দেখা যাচ্ছে, চুমকির নির্দিষ্ট ভাউচারটিতে একটি নিশ্চয় যানের নম্বর দেওয়া রয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে অফিসিয়াল রেকর্ডে ওই নম্বরটি ব্যবহার করে রোগীকে তুলেছে হাসপাতালের বেসরকারি প্রি-পেড অ্যাম্বুল্যান্সের তালিকাভুক্ত পৃথক নম্বরওয়ালা একটি প্রাইভেট গাড়ি। আর সেই গাড়ির চালকই ভুল বুঝিয়ে বর্ধমান মেডিক্যালের পরিবর্তে তপনবাবুদের নবাবহাটের নার্সিংহোমে নিয়ে যান বলে অভিযোগ।

বিষয়টি ধরা পড়তেই তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চুমকির জন্য বরাদ্দ হওয়া নিশ্চয় যানটিকে আপাতত সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, সেটি এবং অভিযুক্ত প্রি-পেড অ্যাম্বুল্যান্স চালকের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। যদিও শনিবার সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে অভিযুক্ত চালক টিঙ্কু শেখ দাবি করেছেন, ‘‘আমি রোগী নিয়ে বর্ধমান মেডিক্যালেই যাচ্ছিলাম। পথে বোলপুরের কাছে ওঁদের (চুমকির পরিজন) কাছে একটি ফোন আসে। তার পরেই ওঁরা আমাকে নবাবহাটের ওই নার্সিংহোমে যেতে বলেন।’’ যদিও টিঙ্কুর ওই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন মৃত তপনবাবুর স্ত্রী অণিমাদেবীর। উল্টে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন ওই চালক-চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, সেই প্রশ্নও তিনি তুলেছেন।

এত বড় ঘটনার পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে ওই চক্রের বিরুদ্ধে তেমন তৎপর হয়নি, তার নমুনা দেখা গিয়েছে এ দিনও। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেল, রোগী সহায়তা কেন্দ্রের সামনে প্রি-পেড অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের ভিড়। একই রকম ভিড় নিশ্চয় যান চালকদেরও। রোগী ‘ধরতে’ প্রাইভেট গাড়ির চালকদের একই রকম ভিড় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনেও। এমনকী, গাড়ির চালক থেকে মালিক— রেফার হওয়া বা ছুটি পাওয়া রোগীদের নিয়ে যেতে অবাধে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোথাও দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছেন। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছুটি হওয়া রোগীর থেকে তাঁরা বেশি করে টার্গেট করেন রেফার কেসগুলিকে। কেন? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক অ্যাম্বুল্যান্স চালক বলেন, ‘‘বর্ধমানের নার্সিংহোমগুলোর সঙ্গে আমাদের সেটিং থাকে। রোগী পিছু ৫-১০ হাজার টাকা অবধি মেলে।’’ রোগী পেতে নার্সিংহোম মালিকেরা প্রতিনিয়ত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন বলেও ওই চালকের দাবি।

এত রেফারই বা কেন?

হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত বছরের ২৬ জানুয়ারি রোগীকল্যাণ সমিতির সভায় রেফার নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা পড়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে, শেষ তিন মাসে হাসপাতাল থেকে মোট ১০৯৯ জন রোগীকে রেফার করা হয়েছিল। আর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশকে রেফার করেছে এই হাসপাতাল। জেলার এক স্বাস্থ্য আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘এই হারকে আমি স্বাভাবিক বলব না। আবার ভীষণ অস্বাভাবিক, এমনটাও নয়। তবে, হারটা আরও কম হওয়া উচিত।’’ অবশ্য আগের তুলনায় রেফারের হার কমেছে বলে দাবি করেছেন হাসপাতাল সুপার সুবোধকুমার মণ্ডল। রেফার-রোগের নেপথ্যে ওই হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক-কর্মীদের অভাবকেই দুষছেন বহু চিকিৎসক।

রোগী সহায়তা কেন্দ্রে প্রি-পেড অ্যাম্বুল্যান্সের সুবিধা চালু করেছিল মহকুমা প্রশাসন। চালক-চক্রের বিরুদ্ধে কেন পদক্ষেপ করা হচ্ছে না? সুবোধবাবু বলেন, ‘‘এটা মহকুমা প্রশাসনের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই।’’ এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাস বলেন, ‘‘কী পদক্ষেপ করা দরকার, তা ঠিক করতে আগামী মঙ্গলবার সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক ডেকেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন