৫ জুন, ২০১৬-য় যে শিশুর জন্ম হবে, অথবা তার পরে, অথবা তারও পরে, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তেই, একটা জায়গায় তার ঈর্ষা আমাকে ছুঁয়ে যাবে, যাবেই। মহম্মদ আলি নামে এক রক্তমাংসের কিংবদন্তীর সঙ্গে এক পৃথিবীর এক হাওয়ায় একসঙ্গে শ্বাস নিয়েছি আমি। মূর্ত বর্ণময়তার অপূর্ব ছটায় প্রত্যক্ষত রঙিন হয়েছি। আমি মানে, আমার মতো কয়েকশো কোটি মানুষ, মহম্মদ আলির সঙ্গে একই সঙ্গে এক আকাশের তলায় থাকার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনার যারা শরিক।
কিন্তু কোন সেই মহম্মদ আলি? ‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট’ বা তার পরেও ‘আই অ্যাম নট দ্য গ্রেটেস্ট, আই অ্যাম ডাবল গ্রেটেস্ট’ বলেন যিনি, তিনি? নাকি আঠারো বছরের সেই কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর, যে অলিম্পিকের সোনার মেডেলটাকে ক্ষোভে-রাগে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নদীর গর্ভে, কারণ সে দেখেছিল কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে কী তীব্র বিদ্বেষের শিকার তারই মতো অনেকে? অথবা, না-হারার মানসিকতাকে আরও তীব্র করে যে যুবক ক্রমাগত বক্সিং রিঙে নিজেকে মেলে ধরতে থাকে প্রজাপতির মতো ভেসে আর মৌমাছির মতো দংশনে?
এ সবের মধ্যে বিরাটত্ব আছে, কিন্তু মহম্মদ আলি তো অতিবিরাট! অতএব উত্থানের সেরা সময়েই এসে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, উর্দি চড়িয়ে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ আসে এবং আসে অতিলৌকিক সেই নির্দেশ-অমান্যের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। মহম্মদ আলি বললেন, ‘‘না, যাব না আমি। একটা গরিব দেশের বাদামি লোকেদের হত্যালীলায় মাততে পারব না আমি। পৃথিবী জুড়ে কালো বা বাদামি মানুষদের উপর শ্বেত প্রভুদের আধিপত্য কায়েমের চেষ্টার শরিক হতে পারব না। এটা আমার অন্তরের বিশ্বাস। আমি জানি, আমার জেল হতে পারে। কিন্তু তাতে নতুন কী? গত ৪০০ বছর ধরে আমরা কৃষ্ণাঙ্গেরা তো জেলেই আছি।’’ অবিশ্বাস্য এই দ্রোহ তাঁকেই মানায়, স্রোতের উল্টোপথে সাঁতারও। জেল হল না, কিন্তু কেরিয়ারের মধ্য গগনে জুটল নির্বাসন। এই মহম্মদ আলির সঙ্গে এক বাতাস ভাগ করে নিয়েছি আমি!
কিন্তু, এহ বাহ্য। এর পর আসবে নির্বাসনমুক্তি। আসবে সেই অমোঘ মুহূর্ত, যখন চ্যাম্পিয়নের খেতাব পুনরুদ্ধার করে ছড়িয়ে দেবেন হুঙ্কার, ‘আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট’। ফিরে আসার অবিশ্বাস্য এক রূপকথার নাম মহম্মদ আলি, হার না-মানার অলৌকিক কাহিনির নাম, নাম সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধার। মহম্মদ আলি কিংবদন্তী।
আর, এই মহম্মদ আলির মধ্যে ছিল অন্য যে মহম্মদ আলি, তাঁকে আবিষ্কার করলাম আমরা অনেক পরে বক্সিং-উত্তর জীবনে। সেই লোকটি নরম মনের, ফিলাডেলফিয়ার হাসপাতালে পা-কাটা যাওয়া এক বাচ্চাকে কোলে তুলে নিচ্ছেন, বলছেন, বিশ্বাস রাখো, তুমি এক দিন হাঁটবে। নেলসন ম্যান্ডেলা জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ছুটে যাচ্ছেন মহম্মদ আলি। বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে যাচ্ছেন কে? রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিদূত মহম্মদ আলি। বিশ্বজুড়ে শান্তির বার্তা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। এবং ঐতিহাসিক সেই বার্তা, ‘অন্যের সেবা করুন। এই পৃথিবীতে যে থাকছেন, তার ভাড়া দিতে হবে না? ওই সেবাটাই আপনার ভাড়া।’
কোন মহম্মদ আলি কিংবদন্তী? আসলে এই সব মিলিয়ে, প্রতিবাদে-বিশ্বাসে-হুঙ্কারে-আত্মঘোষণায়-ভালবাসায়-শান্তিতে সর্বতোগামী এক অবিশ্বাস্য মানুষ মহম্মদ আলি।
ইংরেজিতে বলে, রেস্ট ইন পিস। মহম্মদ আলি, আপনাকে এই কথা বলার স্পর্ধা না হোক কারও। আপনি থাকবেন প্রজাপতির মতো ভেসে ভেসে, বক্সিং রিঙে যেমন থেকেছেন। আমরা চেষ্টা করি, আপনার পথে এই পৃথিবীর ভাড়া চোকানোর।