চপ্পলবাহনা পুরাণের কবিকে আনন্দ-অর্ঘ্য

‘সেই থেকে কুকুধ ও চাঁপা গাছের ভিতর দিয়ে/চীবর ও ভিক্ষাপাত্র হাতে/শব্দগুলি ক্রমাগত হেঁটে যাচ্ছে এক অনশ্বর নীরবতার দিকে।’

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১৯
Share:

সুধীর দত্ত

‘সেই থেকে কুকুধ ও চাঁপা গাছের ভিতর দিয়ে/চীবর ও ভিক্ষাপাত্র হাতে/শব্দগুলি ক্রমাগত হেঁটে যাচ্ছে এক অনশ্বর নীরবতার দিকে।’

Advertisement

তথাগত নন, নীরবতার পথে চলেছে মুখর শব্দরা। জার্মান দার্শনিক হাইডেগার বলেছিলেন, ‘‘ভাষা কবিতার উপাদান নয়। বরং কবিতাই ভাষাকে সম্ভবপর করে।’’ কবি চান, শব্দের আকাশে উড়াল দিক সব প্রাণ, ‘কুঁদে কুঁদে প্রতিটি শব্দের ভিতর তুমি তৈরি করো আকাশ/আর বলো, আলো হোক।’ শব্দ ও বোধিজ্ঞান একাকার। এই কবি শুধু বোধিসত্ত্ব নন, বাইবেলের যে ঈশ্বর বলেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’, তাঁরও প্রতিস্পর্ধী। ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী সেই কবি, সুধীর দত্ত তাঁর ‘তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ’ গ্রন্থের জন্য ১৪২২ সনের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।

মিডিয়ামথিত এই সময়ে সুধীর নন কোনও সেলেব্রিটি কবি। ‘ত্রিপাদ অমৃত যাঁর/ মাত্র একপাদে তাঁর যায় আসে না কিছু।’ বলিরাজা সব দান করবেন, বিষ্ণু বামনের বেশে এসে চাইলেন মাত্র তিন পা জমি। রাজা হাসলেন। বামন ক্রমশ বর্ধিত হয়ে মহাবিষ্ণু রূপে এক পায়ে ঢেকে দিলেন সমস্ত আকাশ, আর এক পায়ে পৃথিবী। তৃতীয় পা রাখলেন দানবরাজের মাথায়। এই দু’লাইনই লিখলে সেটি ধর্মীয় পুরাণগাথা হতো। কিন্তু কবিতার ধর্ম আলাদা। স্বধর্মে স্থিত সুধীর পরক্ষণেই চলে যান অন্য অনুষঙ্গে: ‘মানুষের যায় আসে/যখন ব্রহ্মাণ্ড পোড়ে— রোম ও মিথিলা পোড়ে/পোড়ে শেষ বিশ্বাসটুকু।’ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কয়েক বছর আগে লিখেছিলেন, ‘আমারই অজ্ঞতা, সুধীর দত্তের নাম আগে কখনও শুনিনি, যাঁর কবিতা পড়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছি।’ আনন্দ পুরস্কারের খবরটা জেনে জয় গোস্বামী আনন্দিত, ‘‘আমি ১৯৭৩-’৭৪ সাল থেকে ওঁকে জানি। বিরল কবি, কোনও দিন গোষ্ঠীভুক্ত হননি। ওঁর কবিতা সঙ্কেতধর্মী, সংবাদধর্মী নয়। সেই ভাষ্য বোঝার জন্য পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়, তাই হয়তো লোকপ্রিয় নন।’’

Advertisement

সম্মানিত কাব্যগ্রন্থটি অবশ্য বুঝিয়ে দেয়, কবি সঙ্ঘভুক্ত না হলেও নন সমাজবিবিক্ত। সময় তাঁর কাছে অবিচ্ছিন্ন এক খণ্ডপ্রবাহ: ‘তিন দশক পরেও এই যে/বিজনসেতুর মুখে পেট্রোলে দগ্ধানো ক্ষতস্থান/ধোওয়া হয়নি।’ আনন্দমার্গী হত্যাকাণ্ডেই শেষ হল না ইতিহাসচেতনা। পরের লাইনে জানিয়ে দিলেন, চলমান সময় আজও বোধের বাইরে: ‘অধুনা দুর্বোধ্য আরও— মক্‌ হিরোইক/ চপ্পলবাহনা দেবী সপার্ষদ চলেছেন রণে।’ কিংবা, পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনির রাজ্যে কবি এক দিন চমকে ওঠেন: ‘...ফালাফালা ছিঁড়ে খাচ্ছে/আম মাংস— ঊরুসন্ধি/ বিচ্ছেদে, দু’ভাগ দুইপাশে— হা রাম! / যাবেন না, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি— শঙ্করাচার্য; একটু দাঁড়ান:/ আমি কি উদ্যত লাঠি ছুঁড়ে ফেলব? সর্প ইব ভ্রম!/কিছু না?’ ধর্ষণ দেখলে বৈদান্তিক শঙ্করাচার্য সেটিও অলীক মায়া বলে উড়িয়ে দিতে পারতেন কি না সর্পতে রজ্জুভ্রমে, এই সংশয় উচ্চারণেই কবিতার যাপন।

পুরস্কারের খবরেও সেই যাপনকে এগিয়ে দিচ্ছেন সুধীর, ‘‘আমার তো নামডাক নেই। কবি থেকে কবিতায় যায়নি এই সম্মান, কবিতা থেকেই কবির কাছে এসেছে।’’ আদম, শামিয়ানা-র মতো যে সব ছোট প্রকাশনায় তাঁর লেখালিখি, তারুণ্যের সেই সঙ্ঘারামেও থাকছে তাঁর পুষ্পাঞ্জলি, ‘‘তরুণ কবিরা অনেকে বলছেন, এ তাঁদেরও পুরস্কার।’’

সুধীর দত্ত ছোট পত্রিকার সন্তান। শঙ্খ ঘোষের মনে আছে, প্রায় চার দশক আগে রামচন্দ্র প্রামাণিক ও শরৎসুনীল নন্দী নামে দুই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে সুধীর বার করতেন ‘সংবেদ’ নামে এক পত্রিকা। ওড়িশা-মেদিনীপুর সীমানার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। তিন বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু, চার বছরে বাবার। বিধবা পিসির তত্ত্বাবধানে গ্রামের স্কুল, সেখান থেকে বিদ্যাসাগর কলেজ। অতঃপর একে একে ‘ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া’, ‘আরশিটাওয়ার’, ‘দাহপুঁথি’। এ বারের বইমেলায় বেরিয়েছে ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি।’ সেখানে অশ্বত্থামা ও ওপেনহাইমারকে তিনি জুড়ে দেন একত্রে: ‘তুমিই কি অশ্বত্থামা? ওপেনহাইমার? অরক্ষিতদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছ অগ্নি?’ এই আগ্নেয় উপমা ঘুরে আসে বারবার। পুরস্কৃত বইয়েও আশা, ‘অগ্নিস্নানশেষে বাক ভেদ করবে অন্তরীক্ষলোক/আর ফলশস্যে ভরিয়ে তুলবে ভুঁইকুমড়োর খেত।’ চাকরিজীবনে ধূম্রহীন অগ্নির সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। সরকারি কর্তা হিসেবে তাঁর অন্যতম প্রকল্প ছিল গ্রামগঞ্জে ‘স্মোকলেস চুল্লি’র প্রসার।

কবির চাকরি-তথ্যে কী আসে যায়! কবিত্বের ঐশী শক্তিতেই বিশ্বাসী তিনি, ‘‘আমার ছোট থেকে মনে হতো এই কলসিটার ভেতরে অফুরন্ত শক্তি। স্বপ্নে দেখতাম, একটা আলোর বলয়। আমি ছুটে গিয়ে সেই বলয়ে হারিয়ে যাচ্ছি।’’ অনেকে আধ্যাত্মিকতার গন্ধ পেতে পারেন। এই আধ্যাত্মিকতা আসলে নিজেকে অতিক্রম করার অনুভূতি। ঋগ্বেদে কবিরা মন্ত্র রচনা করতেন না, চোখের সামনে দেখতে পেতেন। ‘হে মন্ত্রপূত শব্দ, শায়কসকল/ তোমাদের গায়ে উত্তরাস্য হয়ে আমি একদিন হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম,’ লিখছেন সুধীর। ‘‘বইটি পড়লে মনে হয়, সারা পৃথিবীর সাহিত্য প্রদক্ষিণ করে একটা পুরাণের সঙ্গে আর একটার সংযোগ ঘটিয়ে গিয়েছেন,’’ বলছেন জয়।

এই সংযোগ স্থাপনেই সুধীরের সাফল্য। সৃষ্টির আদিকথা নিয়ে ঋগ্বেদে দশম মণ্ডলের ১২৯ নম্বর সূক্তটি নাসদীয় সূক্ত নামে পরিচিত। ঋষি জানান, তখন অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল। এর সঙ্গে গ্রিক পুরাণে মানুষের জন্য আগুন চুরি করে-আনা প্রমিথিউসকে পাশাপাশি গেঁথে দেন সুধীর: ‘আমার ডানা নেই/তবুও আমি উড়িয়ে এনেছি আলো/যখন অন্ধকারে আবৃত ছিল অন্ধকার।’

পুরাণ, ইতিহাস ও দর্শনের বহুমুখী সংলাপে ঋদ্ধ সেই কবিকৃতিকেই এ বারের আনন্দ-সম্মান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন