জলে রয়েছে আর্সেনিক। হাতে-পায়ে আর্সেনিকোসিসের স্পষ্ট ক্ষত। তবে বর্ধমানের পূর্বস্থলীর দু’টি ব্লকের কোথাও ওই রোগের চিকিৎসার সুযোগ নেই। নেই জল পরীক্ষার কোনও উপায়।
মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক-দূষিত এলাকার দীর্ঘ তালিকায় পূর্বস্থলী ১ এবং ২ ব্লক রয়েছে বেশ উপরের দিকেই। দু’দশক ধরে অবস্থাটা বিশেষ বদলায়নি। স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, বিশ বছর আগে পূর্বস্থলীর মাদ্রা গ্রামে প্রথম পড়েছিল আর্সেনিকোসিসের ছায়া। রোগাক্রান্ত পরিবারের সাত জন মারাও গিয়েছিলেন একে একে। তবে হুঁশ ফেরেনি স্বাস্থ্য দফতরের।
পালাবদলের পরে সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের ভার এখনও খোদ মুখ্যমন্ত্রী হাতে। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, সেই ভরসায় স্বাস্থ্য ভবনে বার কয়েক আবেদন করা হয়েছিল, সাড়া মেলেনি। ফলে সময় যত গড়িয়েছে, কার্যত জেনেশুনে ‘বিষ পান’ করে তালিকা প্রলম্বিত হয়েছে মৃতের।
সরকারের দুয়ারে কড়া নেড়েও সাড়া না পাওয়ায় কাজে নেমেছিলে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের রিপোর্ট বলছে—দুটি ব্লকের ১৮ টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৬ টিতেই জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। যা শুধু স্থানীয় বাসিন্দা নয়, গবাদি পশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ত্বকের ক্যানসারে ইতিমধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা একশো ছুঁয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে এলাকার বেশ কিছু গবাদি পশুও।
মাদ্রার ঘটনা সামনে আসার পরে নড়েচড়ে বসেছিল সরকার। দূষণমুক্ত পানীয় জল সরবরাহ করতে প্রথমে কুয়ো এবং পরে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পও গড়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল সচেতনতা-প্রচারও। তবে, রাজ্যে পরিবর্তনের পরে সে সবই প্রায় বন্ধ হতে বসেছে বলে স্বাস্থ্য ভবন সূত্রেই জানা গিয়েছে। দফতরের এক কর্তা জানান, বছর ছয়েক আগে ওই দু’টি ব্লকের দু’জন চিকিৎসককে রোগ চিহ্নিতকরণ এবং চিকিৎসার ব্যাপারে প্রাথমিক পাঠ দেওয়া হয়েছিল। শ্রীরামপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খোলা হয়েছিল একটি ‘স্পেশাল ক্লিনিক’। কিন্তু বছর কয়েক আগে প্রশিক্ষিত সেই দুই চিকিৎসক বদলি হতেই পুরনো অবস্থায় ফিরে গিয়েছে পূর্বস্থলী। স্থানীয় কল্যাণপুর গ্রামের হাবিবুল্লা মল্লিক, জলিল মল্লিকের প্রশ্ন, ‘‘আর্সেনিকের থাবা পড়েছে বহু দিন। কিন্তু চিকিৎসা করাতে যাব কোথায়, আমাদের স্পেশ্যাল ক্লিনিক তো উঠে গিয়েছে। বার বার কলকাতা যাওয়া সম্ভব?’’
ফলে দগদগে ক্ষত নিয়েই বেঁচে রয়েছেন তাঁরা। কখনও সুযোগ পেলে কলকাতা যান। তবে অভাবের সংসারে সে সুযোগ বার বার হয় না। জিয়াউদ্দিন শেখ বলেন, ‘‘ওই ক্লিনিক ফের চালু করার দাবিতে ধর্না থেকে অবরোধ— কী করিনি। কিন্তু সরকার সাড়া দিলে তো!’’ পূর্বস্থলীর বাসিন্দা সমর বসাক বলেন, ‘‘ত্বকে কোনও দাগ দেখা দিলেই আমরা আতঙ্কে থাকি, আর্সেনিকোসিস নয় তো!’’
সরকার এগিয়ে না এলেও পূর্বস্থলী ১ ও ২ ব্লক থেকে পানীয় জলের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তবে ওই সংগঠনের দাবি, এ ব্যাপারে গ্রামের সচেতনতাও তেমন নেই। কল্যাণপুরের মাসুদ শেখ বলেন, ‘‘সরকারি জল পরীক্ষাগারটি মন্তেশ্বরে করে পূর্বস্থলীর সাধারণ মানুষের কোন লাভ হয় নি। প্রশাসনের উচিত এলাকার মানুষের নাগালের মধ্যে একটি পরীক্ষাগার করা। এই উদ্যোগটুকু সরকার অন্তত নিক।’’ সরকারি উদ্যোগ বলতে, বছর দুয়েক আগে আর্সেনিক অধ্যুষিত দোগাছিয়ার সোনারুদ্র গ্রামে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর একটি পানীয় জলের রির্জাভার গড়ার ঘোষণা। তবে আর পাঁচটা সরকারি ঘোষণার মতো সে কাজও থমকে রয়েছে। কাজ শুরুর মুখে প্রকল্পের ঠিকাদার মারা যাওয়ায় সে কাজে দাঁড়ি পড়ে গেছে।
স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান তথা তৃণমূল নেতা প্রনবকান্তি রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘রির্জাভার তৈরি না হওয়ায় মাদ্রা, বলরামপুর, বলদেডাঙা, সোনারুদ্র, লক্ষণপুরের মতো গ্রামগুলিতে বাড়ি বাড়ি বিশুদ্ধ পানীয় জল পরিষেবা দেওয়া হয় না। ফলে এলাকার সাধারণ মানুষকে বাধ্য হয়েই আর্সেনিক মিশে থাকা নলকুপের জল পান করতে হয়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘সরকার একটু উদ্যোগ নিলেই স্থানীয় খড়ি নদীর জল দূষণ মুক্ত করে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা যেত।’’ পূর্বস্থলীর (উত্তর) বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের আশ্বাস, বিধানসভায় বিষয়টা ‘উত্থাপন’ করবেন তিনি। নির্বাচিত হওয়ার সাড়ে চার বছরেও সে সুযোগ পাননি তিনি। আর কবে?