সভায় রাজনীতির বাউল গান

দ্রুত লাইনগুলো শেষ করে দোতরা গলায় ঝুলিয়ে হাঁটা দিলেন তিনি। সঙ্গের ঝোলা থেকে প্লাস্টিকে আধ-সেঁকা রুটি আর গুড় বার করে কয়েক কামড় দিয়েই ফের ঝোলায় ভরে রাখলেন। এর পরে মঞ্চের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে শুরু হল তাঁর নিজের লেখা গান গাওয়া। টানা দু’তিনটে গানের পরে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘‘অবনীদাস বাউল আমি। কৃষ্ণনগরে বাড়ি। শহুরে বাবুরা গ্রামে গিয়ে দেখুন, অবনীরা এখনও বাড়ি ফিরতে পারছে না। গ্রামে গিয়ে দেখুন!’’

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৭:৩৯
Share:

ব্রিগেডে অবনীদাস বাউল। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

‘সোনার ফসল ফলায় যে, তাঁর দুই বেলা জোটে না আহার। হিরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই! ভাই রে, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়!’

Advertisement

দ্রুত লাইনগুলো শেষ করে দোতরা গলায় ঝুলিয়ে হাঁটা দিলেন তিনি। সঙ্গের ঝোলা থেকে প্লাস্টিকে আধ-সেঁকা রুটি আর গুড় বার করে কয়েক কামড় দিয়েই ফের ঝোলায় ভরে রাখলেন। এর পরে মঞ্চের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে শুরু হল তাঁর নিজের লেখা গান গাওয়া। টানা দু’তিনটে গানের পরে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘‘অবনীদাস বাউল আমি। কৃষ্ণনগরে বাড়ি। শহুরে বাবুরা গ্রামে গিয়ে দেখুন, অবনীরা এখনও বাড়ি ফিরতে পারছে না। গ্রামে গিয়ে দেখুন!’’

বাবা-মায়ের দেওয়া নাম হরিদাস বিশ্বাস। এখন নিজেকে অবনীদাস বাউল নামেই পরিচয় দেন। নদিয়া জেলায় হলে তো কথাই নেই, তাঁর সঙ্গে রবিবার ব্রিগেডে আসা সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা জানাচ্ছেন, সভা থাকলে সেখানে দোতারা হাতে বাউল অবনীদাসের উপস্থিতি চেনা ছবি। শুধু সভা-সমিতিতে হাজিরাই নয়, যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেও দোতারা হাতে সেখানকার মানুষের সাহায্যে অর্থ সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পড়েন অবনীদাস। নিজেই ঝোলা থেকে কাগজ বার করে দেখালেন, ২০০৪ সালে সুনামির সময়ে গান লিখেছিলেন, ‘নদী তুই ফুঁসলি কেন বল?’ ট্রেনে, বাসে, রাস্তায় সেই গান গেয়ে জোগাড় করা ৩০১ টাকা তুলে দিয়েছিলেন নদিয়ার তৎকালীন জেলাশাসকের হাতে। একই ভাবে ২০০১ সালে গুজরাত ভূমিকম্পের সময়েও গান লিখেছিলেন অবনীদাস। সদ্য কেরলের বন্যার জন্যও অর্থ সংগ্রহে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

Advertisement

রোগা, শীর্ণকায় চেহারাটা দেখলে প্রশ্ন জাগে, তাঁর নিজের বাড়ির অবস্থা কেমন? জানালেন, এক সময়ে রিকশা চালাতেন। সেই টাকাতেই চলত স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক মেয়ের সংসার। পাশাপাশি ছিল, বাবার শেখানো দোতারা বাজিয়ে গান-বাজনা। জানালেন, সেই জীবনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরের বন্যা। অবনীদাসের কথায়, ‘‘বাড়ি ভেসে গিয়েছিল। কোনও মতে বেঁচে ছিলাম। বড় ছেলেটা তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। খাওয়ার টাকা নেই, স্কুলে পড়াব কী করে?’’ জানালেন, ওই বছরই ঘর তৈরি করতে আর নতুন করে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তির টাকা জোগাড় করতে গিয়ে রিকশাটা বিক্রি করে দিতে হয়। তার পর থেকে দৈনিক ৩০ টাকা মজুরিতে অন্যের রিকশা চালানো শুরু করেন অবনীদাস। তবে সেই জীবনে দাঁড়ি টেনে তিনি এখন বাউল। বললেন, ‘‘ওই জীবন আর ভাল লাগল না। বড় ছেলেটা একটু বড় হতেই দোতারা নিয়ে বাউল হয়ে গেলাম। তার পর থেকে ওই ভাবেই চলছে। রাজনীতির গান করি আমি।’’

সেই সঙ্গেই অবনীদাসের দাবি, ‘‘ওই সময়েই বুঝে গিয়েছিলাম, রাজনীতিই আসলে জীবন চালায়।’’ কিন্তু, সেই রাজনীতিই আবার বাড়ি ফিরতে দেয় না। ক্ষমতার পালাবদলের পরে তাঁদের অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেনি বলে জানালেন তিনি। তবু এ দিনও ব্রিগেডে আসতে অবনীদাস ভোরে বেরিয়ে পড়েছেন। দাবি করলেন, বাড়ির লোক এখন অনেক ঝামেলা করে তিনি সভায় যাচ্ছেন শুনলে। ভয় তাঁর নেই, তবে এক দিন ব্রিগেডে আসা মানে সে দিনের মতো গান গেয়ে ভিক্ষা করা বন্ধ! বললেন, ‘‘ব্রিগেডে এসে কারও কাছে হাত পাততে ইচ্ছে করে না।’’ তবে পরিবারের উপরে রাগ নেই বাউলের। বললেন, ‘‘ঘর সারাতে ছেলে ব্যাঙ্ক থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছে। শোধ করতে পারছে না। চাষবাস করে কতটাই বা হয়!’’

এর পরে মঞ্চের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ছেলে-মেয়েদের বোঝাই, কৃষকের কথা, মজুরের কথা বলার লোক আসলে কারা! বাকি বাংলা জুড়ে রঙ্গ চলছে। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন