তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ‘খাসতালুক’, দলের বোলপুর কার্যালয় থেকে নিখোঁজ হয় বর্ধমানের মঙ্গলকোটের দাগী দুষ্কৃতী আজাদ মুন্সি। অনুব্রতর অনুগামীদেরই বিরুদ্ধে আজাদকে খুনের মতলবে অপহরণ করার অভিযোগ দায়ের করল তার পরিবার। শনিবার বিকেলে বোলপুর থানায় এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেছেন আজাদের ভাই আসাদুর ওরফে অঞ্জন মুন্সি।
শুক্রবার আজাদকে চিনতে পেরেছিলেন অনুব্রত। আজাদ নিখোঁজ হওয়ার খবর তাঁর কানে এসেছে বলে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ও কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে যায়নি তো!” এ দিন অবশ্য একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে তাঁর মন্তব্য, “আজাদ মুন্সির মতো ক্রিমিনালকে কোনও দিন দেখিনি। সে আমাদের পার্টি অফিসেও কখনও আসেনি। পার্টি অফিসের সামনে চায়ের দোকানে সে এসে বসত বলে শুনেছি।” আজাদের পরিবার খামোখা অনুব্রত-ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলল কেন? তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতির জবাব, “সব মিথ্যা মামলা। এর সঙ্গে তৃণমূলের কেউ জড়িত নয়।”
তবে আজাদ-ঘনিষ্ঠ নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখ, যিনি জেলা রাজনীতিতে অনুব্রতর-বিরোধী শিবিরের বলে পরিচিত, এ দিন দাবি করেছেন, আজাদ অপহরণ মামলায় যারা অভিযুক্ত, তারা প্রত্যেকে অনুব্রতরই খাস লোক। এমনকী, আজাদ অনুব্রতর আশ্রয়েই ছিল। কাজলের দাবি, “অভিযুক্ত-তালিকায় প্রথম দিকে নাম থাকা কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ যদি নিরপেক্ষ ভাবে দায়িত্ব পালন করে, তা হলেই অনেক রাঘব বোয়ালের নাম বেরিয়ে পড়বে। আর কী বলব!”
অভিযুক্তের তালিকায় নাম থাকা চোদ্দো জনের অন্যতম মঙ্গলকোটে তৃণমূলের লাখুড়িয়া অঞ্চল কমিটির সভাপতি অসীম দাস এবং মঙ্গলকোট পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের শান্ত সরকার। অন্য অভিযুক্তদের মধ্যে শেখ ডাবলু গত লোকসভা ভোটে মঙ্গলকোটের একটি বুথে তৃণমূলের এজেন্ট ছিলেন। সেই বুথেই ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল আর এক অভিযুক্ত লাখুড়িয়া অঞ্চল যুব তৃণমূল সভাপতি শেখ সোনার বিরুদ্ধে। আজাদ অপহরণ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত সাবুল শেখ হলেন লাখুরিয়া অঞ্চল তৃণমূলের একটি গোষ্ঠীর নেতা। দিন কয়েক আগেই কল্যাণপুরে আজাদের দলবল তাঁর উপরে হামলা করেছিল। সাবুল আজাদ ও তার দলবলের বিরুদ্ধে মঙ্গলকোট থানায় অভিযোগও করেন।
পুলিশ ওই ঘটনায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৬৪ ধারায় খুনের মতলবে অপহরণের মামলা রুজু করেছে। এসডিপিও (বোলপুর) সূর্যপ্রতাপ যাদব বলেন, “অভিযুক্তদের কাউকে ধরা যায়নি। আজাদের মোবাইল ফোন উদ্ধারের চেষ্টা করছি।” পুলিশ সূত্রের খবর, বীরভূমের নানুর (দক্ষিণ) এবং বর্ধমানের কেতুগ্রাম এবং মঙ্গলকোট এলাকায় আগামী কয়েক দিন ব্যাপক ভাবে তল্লাশি চালানো হবে।
বছর উনত্রিশের আজাদের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে নানুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাস হত্যা-সহ বেশ কয়েকটি খুন, খুনের চেষ্টা, তোলাবাজি, পুলিশের উপরে হামলা মিলিয়ে অন্তত ২৮টি অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু পুলিশ তার টিকি ছুঁতে পারেনি। অথচ তৃণমূল সূত্রেই খবর, মাসখানেক ধরে বোলপুর থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তৃণমূলের পার্টি অফিসে আজাদ থাকছিল। যে অফিসে বসে বীরভূমে দল চালান অনুব্রত।
শুক্রবার দুপুরে অঞ্জন মুন্সি বোলপুর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন। এ দিন করা অভিযোগে তিনি লিখেছেন, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময়ে তিনি ও আজাদ তৃণমূলের জেলা পার্টি অফিসে বসেছিলেন। সেই সময় আজাদের মোবাইলে একটি ফোন আসে। পার্টি অফিস থেকে দু’ভাই নীচে নামেন। অঞ্জনের দাবি, সেই সময় তৃণমূলের লাখুড়িয়া অঞ্চল কমিটির সভাপতি অসীম দাস, মঙ্গলকোটের ঝিরেলা গ্রামের দুই বাসিন্দাসাইফুল খাঁ এবং সামু শেখের সঙ্গে সেখানে এসে আজাদের সঙ্গে দেখা করেন। তার পরে আজাদ নিজের মোটরবাইক নিয়ে ওই তিন জনের সঙ্গে চলে যান। তার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ।
অঞ্জনের অভিযোগ, “পুরনো রাগ থেকেই খুন করার মতলবে ভাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওরা অপহরণ করেছে। অভিযুক্তদের প্রত্যেককেই বৃহস্পতিবার দিনভর লাখুড়িয়ার রথতলায় স্থানীয় বাসিন্দারা মদ খেয়ে উল্লাস করতে দেখেছেন। জানি না, ভাই কী অবস্থায় রয়েছে!”