খোশমেজাজে। কোল ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠানে পীযূষ গয়াল ও বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুমন বল্লভ।
ভেলপুরি থেকে আইনস্টাইন!
গত শনিবারই নজরুল মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে একসঙ্গে সভা সেরে রাজভবনে ফেরার পথে তিনি নিজেই গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন কেন্দ্রের প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে। শুধু তা-ই নয়, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বাবুলকে ভেলপুরিও খাইয়েছিলেন তিনি। শুক্রবার রাজারহাটে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে থেকে সেই সৌহার্দ্যই যেন ফিরিয়ে দিলেন বাবুল। আর তা করতে গিয়ে হাজির করলেন আপেক্ষিকতাবাদের নয়া তত্ত্ব! যাতে ঠাঁই পেলেন ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
গত শনিবার নজরুল মঞ্চ, রবিবার বার্নপুরের পরে এ দিন রাজারহাট। প্রথম দু’টি ক্ষেত্রে মঞ্চে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই মঞ্চ থেকেই দীর্ঘ ১১ মাসের শীতলতা কাটিয়ে উন্নয়নের প্রশ্নে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য কথা শোনা গিয়েছিল মমতার মুখে। তার পরে আজ। এ দিন রাজারহাটে কোল ইন্ডিয়ার নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় কয়লা প্রতিমন্ত্রী পীযূষ গয়াল ও নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। আর সেখানে প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রশংসায় মেতে ওঠেন। সকলের গলাতেই শোনা গিয়েছে উন্নয়নের প্রশ্নে এক সঙ্গে পথ চলার কথাও। সেখানেই এক ধাপ এগিয়ে রাজ্যের ভূমিকার কথা বোঝাতে গিয়ে বাবুল আইনস্টাইনের তত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যা করলেন!
কী বলেছেন বাবুল? বক্তৃতায় রাজ্যে ‘দিদি’র নেতৃত্বে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বা শক্তি উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে বাবুল বলেন, ‘‘স্কুলে বিগ ব্যাং, থিয়োরি অব রিলেটিভিটি পড়েছিলাম। ই ইক্যুয়ালস টু এম সি স্কোয়্যার। এক দিকে ই যদি এনার্জি হয় এবং অন্য দিকে সি আলোর গতিবেগের বদলে কোল বা কয়লা, তা হলে মাঝে হলেন মমতা দিদি। যদি আপনাকে দু’ দিকে শক্তি ও কয়লার কথা বলতে হয়, তা হলে মাঝে রাজ্য সরকারকে চাই। এখানে ঘটনাচক্রে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মমতাদি। কেন্দ্র যে বিগ ব্যাং-এর মতো বিপুল কাজের পরিকল্পনা নিয়েছে, সেই নতুন অধ্যায়ের সূচনায় আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই।’’
পিছিয়ে ছিলেন না পীযূষ গয়ালও। বাবুলের আগে বলতে উঠে তাঁর মন্তব্য, ‘যে দু’তিন জন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে, মমতাদি তাঁদের অন্যতম। গত জুনে যখন আমি এসেছিলাম, তাঁকে বড় দিদি বলেই মনে হয়েছিল। যাঁর সমর্থন আমি সর্বদা পেয়েছি।’’
পক্ষান্তরে গয়ালকে ভাই সম্বোধনের পাশাপাশি মমতাও জানান, দিল্লিতে গেলে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। এবং বাবুল প্রসঙ্গে তাঁর সরস উক্তি, ‘‘বাবুলকে আর কী ক্রেডিট দেব। ও তো ভূমিপুত্র!’’ হাসির রোল ওঠে প্রেক্ষাগৃহে।
স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী-বাবুল-পীযূষের এই পারস্পরিক প্রশংসা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায় রাজ্য রাজনীতিতে। মমতা অবশ্য এ দিন নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিষয়টির। সন্ধ্যায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মশালায় তিনি বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মিটিংয়ে না গেলে বলা হতো, সৌজন্য দেখাল না। আর গেলে হিন্দু-মুসলমান লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে! তিন হাজার ৩০০ একর জমি দিলাম ইস্কোকে, আর নেপোয় মারবে দই! আমি যাব না! রাজ্য-কেন্দ্র সাংবিধানিক ব্যাপার। সেখানে রাজনীতি নেই।’’
যদিও প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে রাজনীতি নেই, এটা বুঝতে ১১ মাস অপেক্ষা করতে হল কেন মুখ্যমন্ত্রীকে? উঠেছে সৌজন্যের প্রশ্নও। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে একাধিক বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেও মমতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁর মুখোমুখিই হননি! যোগ দেননি কেন্দ্র-রাজ্যের কোনও বৈঠকেও। অবশ্য মাসদুয়েক আগে মমতা দিল্লি গিয়ে মোদীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তার পর থেকেই দু’তরফে বিরোধিতার সুর অনেকটা নরম হয়। আর ছবিটা দ্রুত বদলায় গত শনিবার থেকে। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম রাজ্য সফরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ভালবাসার সঙ্গে কাজ করার কথা। মোদী জোর দিয়েছিলেন ‘টিম-ওয়ার্কের’ উপর।
এ দিন ছিল যেন তারই ‘সিক্যুয়েল’ বা দ্বিতীয় ভাগ। যার সূচনা হয়েছিল মাস তিনেক আগে। কোল ইন্ডিয়ার নয়া ভবন উদ্বোধনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন কয়লা প্রতিমন্ত্রী পীযূষ। তাঁর সঙ্গে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সমীকরণ ভালই। তিনিই প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যিনি রাজ্যে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এ দিনের অনুষ্ঠানে গয়ালকে ‘ভাই’ সম্বোধনের পাশাপাশি মমতা জানান, দিল্লিতে গেলে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়।
অবশ্য পারস্পরিক সৌহার্দ্যের এই আবহেই একটা কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছেন বিজেপির শীর্ষ নেতা তথা দলের সভাপতি অমিত শাহ। বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলকে চাঙ্গা করতে তিনি আজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে রিগিং হয়েছে, তাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব ছিল না। আমার জীবনে এত বড় আকারের রিগিং দেখিনি। পশ্চিমবঙ্গের পুরভোটের ফলকে জনমত হিসেবে দেখা উচিত নয়।’’ একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। ।
সহযোগিতার আবহেই এ দিন কয়লা প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনাদের কয়লা, তাপবিদ্যুৎ বা বিকল্প শক্তির বিভিন্ন প্রকল্প, সম্প্রসারণ বা নতুন প্রকল্প গড়ার জন্য যা প্রয়োজন, সব রকম সাহায্য করবে রাজ্য। এ জন্য আমার অনুমোদনেরও প্রয়োজন হবে না। কারণ আমরা চাই রাজ্যে শিল্প হোক।’’ যদিও এ রাজ্যে শিল্পের পক্ষে বড় কাঁটা হল সরকারের জমি-নীতিই। যা নিয়ে শিল্পমহল একাধিক বার রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে। সেই অভিযোগ ওড়াতে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, রাজ্য সরকার ‘ইস্কো’-র সম্প্রসারণের জন্য ৩৩২৩ একর জমি দিয়েছে। কাটোয়াতে বিনামূল্যে ১৫৬ একর এবং ইসিএলকেও ১০০ একর জমি দেওয়া হয়েছে। এখন কয়লা পেলে কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প তাড়াতাড়ি শুরু হতে পারে বলেও কয়লামন্ত্রীর কাছে আর্জি জানান তিনি। অনুষ্ঠানের আগের বৈঠকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রঘুনাথপুরে প্রকল্পের জন্য সাহায্য চান। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্য সেখানে সরকারি খাস জমি দেবে। এ দিন ডিভিসি, এনটিপিসি-র বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কয়লা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনার উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী জানান, রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র প্রকল্পে স্থানীয় স্তরে পাইপলাইনের কিছু সমস্যা হলেও তা সমাধান হয়ে যাবে। তাঁর আর্জি, আকরিক লোহারও জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা হোক।