বালি ব্রিজ।—ফাইল চিত্র।
“বিরাট সেতু সে এধারের সাথে ওধার জুড়িতে চায়
সে সেতু হয়েছ পার?
এ-ধারে তাহার আলো জ্বলে না ক’ ওধারে অন্ধকার;
…সেতু সে বৃহদাকার।”
প্রেমেন্দ্র মিত্র। সেতু।
ছোটবেলাতে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন খেলা করত। বিবেকানন্দ কি বিবেকানন্দ সেতুতে উঠেছিলেন?
এই প্রশ্ন মাথায় আসত সেই সব দুর্লভ মুহূর্তে, যখন হাওড়া জেলার বালিগ্রামের বাসিন্দা আমি, বাবামায়ের সঙ্গে ট্যাক্সি করে দমদমে মামার বাড়ি যেতাম। ব্রিজে ওঠার আগে ছিল টোল ট্যাক্স। টাকা দিলে একটা গোলাপি কুপন পাওয়া যেত। গঙ্গার ওপারে গিয়ে সেটা টোল কর্মীর হাতে তুলে দিতেন বাবা। চলন্ত ট্যাক্সি থেকে হাত বার করে কুপন তুলে দেওয়ার খন্ড মুহূর্তটিতে বাবাকে সিনেমার হিরো বলে মনে হত!
কিছুদিনের মধ্যেই জেনে গেলাম, বালি ব্রিজের আদত নাম ওয়েলিংডন ব্রিজ। বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশ জমানার ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল ফ্রিম্যান টমাসকে সম্মান জানিয়ে। উনি এই ব্রিজ উদ্বোধন করেছিলন। আরও জানলাম যে ফ্রিম্যান টমাস উইলিংডনের মার্কেজ় ছিলেন।
হাওড়ার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ এই বালি ব্রিজের মাধ্যমে।—ফাইল চিত্র।
উইলিংডন ইংল্যান্ডের একটা জায়গার নাম। আর মার্কেজ় হল আর্ল আর ডিউকের মাঝামাঝি একটা উপাধি। এই তথ্য জানার পরে আমি খুশিই হয়েছিলাম যে ব্রিজের নাম বদলে গেছে। ব্রিটিশরা তাদের পছন্দের নাম দিয়েছে। আমরা আমাদের পছন্দের নাম দিয়েছি। ইতিহাস যে আসলে ক্ষমতাসীনের গল্প, সেটা এই ভাবে শিখেছিলাম।
পরে আবার নাম বদলাল। বালি ব্রিজ হয়ে গেল বিবেকানন্দ সেতু। নাম যাই হোক না কেন, বালি ব্রিজের একটাই কাজ। সেটা হল হাওড়ার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ। যেটা আগে হত জলপথে। ১৯৩১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেতু উদ্বোধন হওয়ার পরে রেল ও সড়ক যোগাযোগও শুরু হল।
‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ অথবা ‘ব্রিজেস অন দ্য ম্যাডিসন কাউন্টি’। হলিউডের ছবিতে ব্রিজের উদযাপন কম নেই। ‘হাওড়া ব্রিজ’ নামে বলিউডের একটি ছবিই আছে। শুধু তাই নয়, বলিউড সিনেমায় কলকাতা শহরকে এস্টাব্লিশ করতে হলে যে ক’টা আইকন দেখাতেই হয়, তার মধ্যে হলদে ট্যাক্সি, ট্রাম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের পরেই হাওড়া ব্রিজ পড়ে। বালি ব্রিজ কিন্তু দুয়োরানি।
গুজরাতের কচ্ছ এলাকার বাসিন্দা, শিল্পপতি এবং রেলের ঠিকাদার রাজবাহাদুর জগমল রাজা চৌহান এই সেতু তৈরির কাজ শুরু করেন। সেটা ১৯২৬ সাল। ব্রিজের ভিত তৈরির জন্যে একশো ফুট গভীর কুয়ো খোঁড়া হয়েছিল। সেই সময়ে ৮৮০ মিটার লম্বা এই ব্রিজ তৈরি করতে এক কোটি টাকা লেগেছিল। জগমল রাজা ছাড়া ব্রেথওয়েট অ্যান্ড কোম্পানিও এই ব্রিজ তৈরিতে সাহায্য করেছিল। প্রথম যে ট্রেনটি এই ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়েছিল তার নাম জগমল রাজা হাওড়া এক্সপ্রেস।
আরও পড়ুন: বরফে পিছল রাস্তা, খাদের কিনারায় গাড়ি, মনে হচ্ছিল আর বেঁচে ফিরব না
আরও পড়ুন: ১৬ দিন পরেও মেঘালয়ের কয়লা খনিতে নিখোঁজ ১৫ শ্রমিক, উদ্ধার শুধু তিনটে হেলমেট
কিন্তু এসব তো শুকনো ইতিহাস। নেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। কলেজ বেলায় এই ব্রিজ দু’বেলা পেরোতে হত ডানকুনি লোকালে চেপে। দিনে দুবার নদীর বাতাসে স্নাত হওয়ার রোমাঞ্চের তুলনা মেলা ভার।
এখন সান্ধ্যভ্রমণে বালি ব্রিজে গেলে দেখতে পাই কমবয়সী ছেলেমেয়েরা পরষ্পরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। অনেকে চুম্বনরত। কিছু মানুষ প্রতিবাদ করে বলেন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সেতুতে আপত্তিকর কাজকর্ম হচ্ছে।আমি ও সব তর্কে নেই। আলিঙ্গনরত তরুণ তরুণীদের দ্রুত পেরিয়ে যেতে যেতে নিজেকে বলি, সেতুর কাজই হল জোড়া।
হাঁটতে গিয়ে আরও অনেক কিছু দেখি। সেল্ফি তোলার ধুম তো সাধারণ ঘটনা। ট্রাইপড এবং অত্যাধুনিক ডিএসএলআর ক্যামেরাসহ ছেলেমেয়েরা আসে আলোকিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ফোটো তুলতে। শরীর চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের দেখি জগিং বা ব্রিস্ক ওয়াক করতে অথবা দৌড়োতে।
অন্য অভিজ্ঞতাও আছে। দূর থেকে দেখেছি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ মারছেন যুবতী বা বৃদ্ধ। পরে জেনেছি, মেয়েটিকে বাঁচানো গিয়েছিল। প্রেমে দাগা খেয়ে তার এই মৃত্যুকামনা। মৃত বৃদ্ধটির আত্মহত্যার কারণ একাকীত্বজনীত হতাশা। তাঁকে কেউ দেখার নেই।
আজকাল ব্রিজের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মাঝে মধ্যেই আলো জ্বলে না। দক্ষিণেশ্বরে স্কাইওয়াক তৈরি হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক যানজট হচ্ছে শনি আর রবিবার। ব্রিজের রাস্তায় মাঝেমধ্যেই বড় বড় গর্ত দেখা যায়। সেটা সারানো যে কার দায়িত্ব, আজও জানা হল না। ট্রাফিক জ্যাম শুরু হলে ফুটপাথ দিয়ে বাইক আর স্কুটার যেতে শুরু করে। পথচারীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে রোজ। কার কাছে অভিযোগ জানাব?
অবহেলায় পড়ে রয়েছে বালি ব্রিজ।—ফাইল চিত্র।
এক শ্রেণির মানুষের পানের পিক আর গুটখা ছিটিয়ে যান সেতুর ধাতব শরীরে। শুনেছি, এর ফলে সেতুর ক্ষতি হচ্ছে। কে এদের আটকাবে? সেতুর গা থেকে ধাতব পাত তুলে নিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতিরা। কোনও প্রতিকার হবে না?
আমার সাধের ব্রিজ এত অযত্নের শিকার। কিন্তু হাওড়া আর কলকাতা শহরকে জুড়েছে আরও যে তিনটি সেতু, তাদের যত্নের কোনও অভাব নেই। হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু, দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ বা বিদ্যাসাগর সেতু এবং ২০০৭ সালে নির্মীত নিবেদিতা সেতু সারাক্ষণ ঝকঝক করে।
সেতু আসলে কী করে? দুটি প্রান্তকে জোড়ে। সেটি দুই ভূখণ্ড হতে পারে, দুই কালখণ্ড হতে পারে, অন্য আরও কিছু হতে পারে। বালি ব্রিজ কলকাতার সঙ্গে হাওড়া জুড়েছে, অতীতের সঙ্গে বর্তমান জুড়ে চলেছে প্রতিটি মুহুর্তে, আকাশের সঙ্গে নদীকে জুড়ছে, জীবনকে জুড়ছে মৃতুর সঙ্গে, যৌবনের উদযাপনকে জুড়ছে বার্ধক্যের অসহায়তার সঙ্গে।
আজ যখন সান্ধ্য ভ্রমণে বেরোব তখন মনে পড়বে এই ২৯ ডিসেম্বরে উদ্বোধন হয়েছিল বালি ব্রিজের। ১৯৩১ থেকে ২০১৯ – লম্বা সময়। যে বৃদ্ধটি একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে এই সেতু থেকে ঝাঁপ মেরেছিলেন, তার মত বালি ব্রিজও একদিন গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে না তো?
ব্রিজকে বলি, তুমি একা নও। তোমার পাশে আমার মত আরও অনেকে আছেন। হ্যাপি বার্থডে বালি ব্রিজ! তোমার জন্যে রইল বিনয় মজুমদারের লেখা কবিতার লাইনদু’টি।
‘সেতু চুপে শুয়ে আছে, সেতু শুয়ে আছে তার ছায়ার উপরে।
ছায়া কেঁপে কেঁপে ওঠে থেকে-থেকে জয়ী হওয়া সেতুর বাতাসে।’