কোনওটায় ছ্যাতলা পড়েছে। কোনওটা বা ধুলো জমে বিবর্ণ। গলে গিয়েছে টাকার বান্ডিলে বাঁধা রবার ব্যান্ডগুলোও। বালি পুরসভার সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারীর বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকার মধ্যে বেশ কিছু নোটের এমন চেহারা! যা দেখে দুর্নীতি দমন শাখার (এসিবি) অফিসারদের অনুমান, বছরের পর বছর ধরে এই সব টাকার বান্ডিল দেওয়ালের গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা ছিল। এক বার রেখে দেওয়ার পরে আর সেগুলোয় হাত পড়েনি। কেন ওই টাকা দীর্ঘদিন এ ভাবে বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছিল, এখন তার জবাব খুঁজছেন এসিবি-র অফিসারেরা।
ক’দিন আগে এসিবি-র তদন্তকারীরা যখন প্রণববাবুর বাড়িতে হানা দেন, তখনও তাঁরা বুঝতে পারেননি, সেখানে কোটি কোটি টাকা মিলবে। ফলে যখন দেওয়ালের টাইলস খুলে বা অব্যবহৃত কমোডের ভিতর থেকে তাড়া তাড়া টাকার বান্ডিল বেরিয়ে এসেছে চোখ কপালে উঠেছিল তদন্তকারীদের। প্রণববাবুর বাড়ি থেকে নগদ ২০ কোটি টাকা উদ্ধার করেন তাঁরা। কেন ওই টাকা খরচ করেননি তিনি, কেনই বা সেগুলো ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে গচ্ছিত রাখার অনীহা ছিল তাঁর, তা জানতে বুধবার সকালে প্রণববাবুর স্ত্রী কৃষ্ণাদেবী ও বাবা জগন্নাথ অধিকারীকে ভবানী ভবনে দুর্নীতি দমন শাখার অফিসে তলব করা হয়। সেখানে তাঁদের সঙ্গে প্রণববাবু ও ছেলে তন্ময়কে কয়েক ঘণ্টা জেরা করেন তদন্তকারীরা।
এসিবি সূত্রের খবর, প্রণববাবুর বাড়িতে তল্লাশি করে যে ডায়েরি মিলেছে তাতে শেষ এক বছরের পাওনাগণ্ডার হিসেব রয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও আরও একাধিক ডায়েরি প্রণববাবু ব্যবহার করতেন, অনুমান গোয়েন্দাদের। তাঁর স্ত্রীকে জেরা করে আরও ডায়েরি কোথায় আছে জানা গিয়েছে। সেগুলির খোঁজে প্রণববাবুর বাড়িতে আরও এক দফা তল্লাশি চালাতে পারে এসিবি। জেরায় প্রণববাবু জানিয়েছেন, ১৯৯৯ থেকে বাড়ির নকশা অনুমোদন-সহ নানা কাজে তিনি টাকা নিতেন। তবে এ সব নিয়ে তিনি কোনও দিন পরিবারের লোকের সঙ্গে আলোচনা করেননি বলে পুলিশকে বলেছেন কৃষ্ণাদেবী।
তদন্তকারীদের একাংশের মত, বিপুল টাকা জমানোর নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন প্রণববাবু। সব পুর-কাজেই ‘প্রণামী’ নিতেন তিনি। এসিবি-র অনুমান, সে কাজে বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও পাশে পেয়েছিলেন তিনি। গত কয়েক বছরে ঘুষের পরিমাণ তিনি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর সব টাকাই বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
টাকা রোজগারের নেশা ওই ইঞ্জিনিয়ারকে কতটা আঁকড়ে ধরেছিল তদন্তের পাশাপাশি সেটাও বুঝতে চাইছেন গোয়েন্দারা। দফায় দফায় জেরার সময় দু’-তিন বার প্রণববাবু বলেছেন, তাঁর বাড়িতে জমানো টাকার পরিমাণ যে কোটিতে ছুঁয়েছিল তা তিনি নিজেই জানতেন না। তবে নির্মাণ সংক্রান্ত যে কোনও কাজের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার কথা কবুল করে নিয়েছেন তিনি।
কেন এ ভাবে টাকা জমিয়ে রাখতেন প্রণববাবু?
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের কথায়, ‘‘বাড়িতে টাকা জমিয়ে রাখাটা যেমন স্বাভাবিক নয়, আবার অসম্ভবও নয়। কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের বিশেষ কিছু জিনিস জমিয়ে রাখাটাই নেশা। সে রকমই হয়তো কালো টাকা খরচ করার উপায় ছিল না বলে রোজগার করে শুধু তা বাড়িতে জমিয়েই রাখতেন ওই ব্যক্তি।’’ আবার মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের বক্তব্য, ‘‘কারও কারও জিনিস জমানোর নেশা থাকে। সে ভাবেই ওই ব্যক্তি টাকা জমিয়েছিলেন। তবে তা বাইরে বার করতে বা খরচ করতে চাইতেন না। নিজের কাছে জমিয়ে রেখে নিজেকে শক্তিশালী ভেবে আত্মসুখ লাভ করতেন।’’
পাড়ার মুদির দোকান থেকে ধারে জিনিস কেনা, বাড়ির কাজের লোকের বেতন বাকি রাখা কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মাকে মাসে ৫০০ টাকা খরচ দেওয়ার মতো প্রণববাবুর যে চারিত্রিক গুণসমূহের খোঁজ মিলেছে, সেগুলো লোকদেখানো নয় বলেই মনে করেন মনোবিদেরা। নীলাঞ্জনা বলেন, ‘‘অনেক টাকা রোজগার করলেও কত কম খরচে জীবনযাপন করা যায় সেটাই ছিল তাঁর মূল
লক্ষ্য। এটিও টাকা জমিয়ে রেখে আত্মসুখ লাভ করার মানসিকতারই একটা আভাস।’’
দুর্নীতি দমন শাখা সূত্রের খবর, জেরার গোড়ায় বিপুল টাকার উৎস জানাতে গিয়ে বিবিধ গল্প ফেঁদেছিলেন প্রণববাবু। কখনও বলেছেন ওই টাকা পারিবারিক আলুর ব্যবসার, কখনও বলেছেন কাকার গ্যারাজের ব্যবসা আছে, সেখান থেকেই রোজগার হয়েছে। কিন্তু তদন্তে সে সবের
প্রমাণ মেলেনি। তদন্তকারীরা জানান, দীর্ঘ জেরায় প্রণববাবু স্বীকার করেছেন, আয়কর দফতরের ভয়ে তিনি ঘুষের টাকা ব্যাঙ্কে রাখতে পারেননি। আবার প্রতিবেশীদের প্রশ্নের মুখে পড়ার ভয়ে জীবনযাত্রাতেও বিলাসিতা দেখাতে পারেননি। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সাধারণ জিন্স-টি শার্ট পরে পুরনো একটা মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতেন প্রণববাবু। তাঁর স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও জীবনযাত্রায় কোনও বিলাসিতা দেখাতেন না।
এরই মধ্যে যে প্রমোটারের অভিযোগে প্রণববাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই আত্মপ্রকাশ এ দিন লিলুয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। কেন তিনি দুর্নীতি দমন শাখায় অভিযোগ করলেন তা নিয়ে হাওড়ার ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শৈলেশ রাই তাঁকে ফোন করে তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওই প্রমোটারের। শৈলেশ অবশ্য এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার ওয়ার্ডের বাসিন্দা হরেন্দ্রপ্রসাদ সিংহের সঙ্গে কাজের টাকার বখরা নিয়ে গত তিন বছর ধরে আত্মপ্রকাশের গোলমাল চলছে। আমি বসে মিটিয়ে নিতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেননি। তাই ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, কেন তিনি এলেন না?’’ বালির বিষয়ে কেন তিনি মাথা ঘামাতে যাবেন, প্রশ্ন হাওড়া পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলরের। পুলিশ অবশ্য এ নিয়ে এখনই মুখ খুলতে চাইছে না।