শ্যামাপদ কাণ্ড

‘উদ্ধত’ ডাক্তারের প্র্যাক্টিসও বন্ধের চেষ্টা

মুখ্যমন্ত্রীর কোপে পড়ে হাসপাতালে যাওয়া আগেই বন্ধ হয়েছে। এ বার সেই সরকারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করতে তৎপর হল রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল। তিনি শ্যামাপদ গড়াই— বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন)-র প্রাক্তন অধিকর্তা। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে যিনি মুখ্যমন্ত্রীর ‘মুখে মুখে কথা বলা’র সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড হন।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫ ০৩:২৯
Share:

কথার উপর কথা! চার বছর আগে বিআইএনে মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী ও শ্যামাপদ গড়াই। —ফাইল চিত্র।

মুখ্যমন্ত্রীর কোপে পড়ে হাসপাতালে যাওয়া আগেই বন্ধ হয়েছে। এ বার সেই সরকারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করতে তৎপর হল রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল।

Advertisement

তিনি শ্যামাপদ গড়াই— বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন)-র প্রাক্তন অধিকর্তা। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে যিনি মুখ্যমন্ত্রীর ‘মুখে মুখে কথা বলা’র সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড হন।

সেই ইস্তক চার বছর শ্যামাপদবাবু সাসপেনশনেই রয়েছেন। যদিও বেসরকারি হাসপাতালে বা নিজের চেম্বারে তাঁর প্র্যাক্টিস বন্ধ করা যায়নি। এ বার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে ওই স্নায়ুরোগ-চিকিৎসকের প্র্যাক্টিস বন্ধের তোড়জোড় শুরু করেছে কাউন্সিল।

Advertisement

এবং এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাউন্সিলের সভাপতি তথা তৃণমূলের বিধায়ক-চিকিৎসক নির্মল মাজি, এসএসকেএমে কুকুর-কাণ্ডের মূল ‘হোতা’ হিসেবে যাঁর দিকে আঙুল উঠেছে। ‘‘আমরা শ্যামাপদবাবুর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করছি। এটা পাকা। তবে বাতিলের মেয়াদ দু’বছর হবে নাকি পাঁচ বছর, সেটা ঠিক করা বাকি আছে।’’— জানিয়েছেন নির্মলবাবু। সঙ্গে এ-ও জুড়েছেন, ‘‘শ্যামাপদ গড়াইয়ের অনেক বড় বড় কথা সহ্য করা হয়েছে। আর নয়।’’ কোন অভিযোগের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত?

তৃণমূলের চিকিৎসক-নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘অভিযোগ ছিল, শ্যামাপদবাবু একটি ছেলের ভুল অপারেশন করেছিলেন। তা প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তি হচ্ছে।’’ নির্মলবাবুর দাবি অনুযায়ী, বছর পাঁচেক আগে বিআইএনে এক তরুণের অস্ত্রোপচার হওয়ার পরে দেখা যায়, নাকের ভিতরে খানিকটা গজ থেকে গিয়েছে। তা থেকে সংক্রমণ হতো, পুঁজ বেরতো। পরিজনেরা শ্যামাপদবাবুর বিরুদ্ধে কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। ‘‘সংবাদমাধ্যম ওঁকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মহৎ ডাক্তার করে তুলেছে। আদতে উনিও অনেক ভুল করেছেন।’’— পর্যবেক্ষণ নির্মলবাবুর।

শ্যামাপদবাবু অবশ্য বলছেন, কাউন্সিলের ওই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁর কিছু জানা নেই। ওঁর কথায়, ‘‘কাউন্সিল বছর দেড়েক আগে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। গিয়েছিলাম। এ-ও জানিয়েছিলাম, আমার করা অপারেশনের সময়ে গজ থেকে যায়নি। পরে ওঁরা অন্য কোথাও অপারেশন করিয়েছিলেন। সেখানেই ঘটেছিল।’’

কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত শুনে স্বাস্থ্যকর্তা ও কাউন্সিলের বড় অংশও বিস্মিত। এই মহলের বক্তব্য: অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হওয়াটাই কাম্য। কিন্তু তার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। প্রশ্ন উঠেছে, শ্যামাপদ গড়াইয়ের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত কি নিয়ম মেনে সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়েছে?

নির্মলবাবুর দাবি, ‘‘সব দিক বিবেচনা করে আমি সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। আগে অভিযুক্তকে ডেকেও পাঠানো হয়েছিল।’’ যদিও কাউন্সিল-সূত্রের খবর: অধিকাংশ সদস্যই এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। রেজিস্ট্রেশন বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত একক ভাবে নেওয়া যায় কি না জিজ্ঞাসা করা হলে জবাব মেলেনি। ফোন কেটে দিয়েছেন, এসএমএসের উত্তর দেননি। কাউন্সিলের প্রাক্তন সভাপতি অশোক চৌধুরী বলেন, ‘‘সব সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে, অভিযুক্তকে বক্তব্য পেশের যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে তবেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।’’

কাউন্সিল-সূত্রের খবর: রেজিস্ট্রেশন বাতিল হলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার স্বাস্থ্য-সচিবের দ্বারস্থ হতে পারেন। তার পরেও কোর্টে যাওয়ার সুযোগ আছে। এ দিকে কুকুর-কাণ্ডে জড়ানোর সুবাদে খোদ নির্মলবাবুরই ডাক্তারি-রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার জন্য জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলে (এমসিআই)-র দ্বারস্থ একাধিক চিকিৎসক সংগঠন। এ অবস্থায় নির্মলবাবু কী ভাবে অন্যের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসক সংগঠন আইএমএ-র একাধিক সদস্য। এক জনের মন্তব্য, ‘‘ভুল-ত্রুটি হতেই পারে। কিন্তু মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে চেয়ে নির্মলবাবু তো মেডিক্যাল এথিক্সেরই সত্যনাশ করে ছেড়েছেন!’’

এ প্রসঙ্গে নির্মলবাবুর প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তৃণমূলের একাধিক চিকিৎসক-নেতা অবশ্য জানাচ্ছেন, চিকিৎসা-বিভ্রাটের জন্য নয়, মুখ্যমন্ত্রীর মুখের উপরে কথা বলার ‘অপরাধেই’ শাস্তি পেতে হচ্ছে প্রবীণ ওই নিউরোসার্জনকে। ঠিক কী হয়েছিল? ঘটনাটা ঘটেছিল ২০১১-র মে মাসে। পালাবদলের ঠিক পরে পরে, যখন কিনা নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শনে যাওয়াটা প্রায় নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন। ২৬ মে তেমনই এক সকালে মমতা বিআইএনে গেলে শ্যামাপদবাবু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভিড়ে ঠাসা হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রীর সপার্ষদ পরিদর্শনের জেরে রোগীদের ভোগান্তি হচ্ছে। মমতা তাঁকে দেখা করতে বললে শ্যামাপদবাবু বলেন, নিজের রোগী দেখা সেরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় পাবেন।

‘ধৃষ্টতা’র ফল মিলতে দেরি হয়নি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শ্যামাপদবাবু সাসপেন্ড হয়ে যান। তার আগে নিয়ম মেনে ওঁকে শো-কজও করা হয়নি!

স্বাস্থ্য প্রশাসনে অনিয়মের সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলছে বলে আক্ষেপ করছেন চিকিৎসক মহলের বড় অংশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন