চলমান এটিএম। মঙ্গলবার, সল্টলেকে। — স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
মাস পয়লার চ্যালেঞ্জ!
নোট বাতিলের পরে এত দিন লড়াইটা ছিল শুধু নগদ জোগানোর। কাল, বৃহস্পতিবার মাসের প্রথম দিনে বেতন আর পেনশন-প্রত্যাশী ভিড়ের মুখোমুখি হবে ব্যাঙ্ক।
মঙ্গলবারই সরকারি কর্মীদের একাংশের বেতন ঢুকতে শুরু করেছে অ্যাকাউন্টে। সঙ্গে পেনশনভোগীদের টাকাও। মাস পয়লার আঁচও এ দিনই পেতে শুরু করেছে ব্যাঙ্ক। কারণ, এক দিকে যেমন পেনশন ও বেতন তুলতে ইচ্ছুকদের ভিড়, তেমনই প্রায় সকলেই চাইছেন সরকারের বেঁধে দেওয়া সর্বাধিক অঙ্কের টাকা প্রথমেই তুলে নিতে। কারণ, মাসের প্রথমে বহু খরচই নগদে মেটাতে হবে। আবার এটিএম থেকে দিনে আড়াই হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না।
কলকাতা পুলিশ-সহ রাজ্য সরকারের বহু বিভাগেই এ দিন বেতন হয়েছে। পুলিশের এক সহকারী কমিশনার জানান, চেকে ২৪ হাজার টাকা তুলতে দুপুর দেড়টা নাগাদ এক জনকে এনএস রোডে এসবিআইয়ের মেন শাখায় পাঠান তিনি। লাইনে তখন ৬০০ জন। তাতে ব্যাঙ্ক জানায়, ৬টার পরে আর টাকা দেওয়া হবে না। চেক নিয়ে ফিরে আসেন ওই ব্যক্তি।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় এ দিন থেকেই বহু ব্যাঙ্কই বিভাজন নীতির পথে হাঁটছে। ঠিক হয়েছে, সংশ্লিষ্ট শাখায় অ্যাকাউন্ট থাকলে গ্রাহকেরা অগ্রাধিকার পাবেন। একই ব্যাঙ্কের অন্য শাখার গ্রাহক গুরুত্ব পাবেন কম। এ দিন বি বা দী বাগে ইলাহাবাদ ব্যাঙ্কের সিনিয়র ম্যানেজার (অপারেশনস) তপন সরকার বলেন, ‘‘শাখার গ্রাহকদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে দশ হাজার, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। অন্য শাখার গ্রাহকদের টাকা দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, নোট বাড়ন্ত।’’ এসবিআইয়ের ডালহৌসি স্কোয়ার শাখা মঙ্গলবার তাদের গ্রাহকদের সর্বাধিক ২৪ হাজার টাকাই দিয়েছে। অন্য শাখার গ্রাহকেরা পেয়েছেন দু’হাজার টাকা করে!
ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার যোধপুর পার্ক শাখাও এ দিন জানায়, নোট থাকলে শাখার গ্রাহকদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বাধিক ২৪ হাজার করে দেওয়া হবে। তাঁদের চাহিদা মেটার পরে অন্য শাখার গ্রাহকদের কথা বিবেচিত হবে। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কারেন্সি চেস্ট থেকে রোজ ৩০ লক্ষ টাকার বেশি নোট পাচ্ছি না। অথচ দিতে হচ্ছে ৪০ লক্ষের উপরে। আগের দিনের জমার একাংশ দিয়ে ঘাটতি মেটাচ্ছি।’’ ওই ব্যাঙ্ককর্তার কথায়, ‘‘১-২ তারিখ নাগাদ চাহিদা থাকবে দিনে ৭০-৮০ লক্ষ টাকা। কারেন্সি চেস্ট অতটা সম্ভবত দিতে পারবে না। তাই এখনই তৈরি হচ্ছি। অন্য শাখার গ্রাহকদের ফেরানোর এটা একটা কারণ।’’
নিজের শাখাতেও এ দিন বেতন থেকে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার টাকা পাননি বহু গ্রাহক। এসবিআইয়ের ডালহৌসি শাখায় অ্যাকাউন্ট লালবাজারের এক এসআই-এর। তুলতে পেরেছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা। গার্ডেনরিচ থানার আর এক পুলিশকর্মীও তুলতে এসেছিলেন ২০ হাজার। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে বৃদ্ধা মা অসুস্থ। ডাক্তার, ওষুধ বাবদ মাসের শুরুতেই নগদ ২০ হাজার টাকা দরকার।’’
এ দিন সকাল পৌনে ১১টায় ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পাহাড়পুর শাখা জানায়, নোটের জোগান কম। প্রত্যেক গ্রাহক চার হাজারের বেশি পাবেন না। এর জেরে প্রায় তিনশো গ্রাহক বিক্ষোভ দেখান। মিনিট কুড়ি অবরোধও হয় পাহাড়পুর রোড।
কাঁকুড়গাছির এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী বলেন, ‘‘১০ তারিখ থেকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ১০-১২ ঘণ্টা করে কাজ করছি। তাতেও গ্রাহকদের খুশি করা যাচ্ছে না। সম্ভবও নয়। এ বার বেতন আর পেনশনের টাকা ঢুকছে। কী যে হবে!’’ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মানিকতলা শাখার ম্যানেজার অরূপকুমার গণ বলেন, ‘‘পেনশন তুলতে আসা প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিতে চেষ্টা করব আমরা। যাতে তাঁদের বারবার আসতে না হয়।’’
তবে, এ দিন এসবিআই-এর আর এন মুখার্জি রোড শাখার মতো পরিস্থিতি হলে সব পরিকল্পনাই ভণ্ডুল হতে পারে! বেলা ১২টার মধ্যেই এ দিন সেখানে নোট ফুরিয়ে যায়। এসবিআইয়ের ডালহৌসি শাখার ম্যানেজার চন্দন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘রোজ আমাদের শাখায় গড়ে নগদ প্রয়োজন এক কোটি টাকার বেশি। অথচ, হাতে পাচ্ছি মাত্র ৫০ লক্ষ!’’
সমস্যা বহাল এটিএমেও। এক দিকে নতুন পাঁচশোর নোটের জোগান অনেক কম, অন্য দিকে সেই নোট রাখার উপযোগী হয়ে ওঠেনি শহরের বহু এটিএম-ই। ফলে, শুধু দু’হাজারি নোট নিতে জনতার বড় অংশ যাচ্ছেন না। ধর্মতলায় টিপু সুলতান মসজিদের কাছে টাকা থাকা সত্ত্বেও ফাঁকা এটিএমের রক্ষী বললেন, ‘‘বিকেলের দিকে নোট ঢুকেছিল। পরের দেড় ঘণ্টা নতুন পাঁচশো মিলেছে। তার পর থেকে শুধুই দু’হাজারের নোট। তাই আর লোকও আসছে না।’’
ডালহৌসি, গিরিশ পার্ক, মানিকতলা, উল্টোডাঙা, কাঁকুড়গাছিতে এ দিনও বহু এটিএমের ঝাঁপ ছিল অর্ধেক নামানো। সঙ্গে ‘নো ক্যাশ’ নোটিস। মানিকতলার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লাইনে সুপ্রতিম চৌধুরী বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম চারটে কার্ডে আট-দশ হাজার তুলে মাস শেষের খরচ চালিয়ে নেব। হল না। অগত্যা অফিস ছুটি নিয়ে ব্যাঙ্কে।’’
এরই মধ্যে চাঁদনি চকে এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের এটিএমে ২০০০ টাকা তুলতে গেলে শুধুই ১০০ টাকার নোট। যেন মরূদ্যান!