হাতকড়া পরিয়ে কাঠগড়ায় পুলিশ

ধারা ছিল জামিনযোগ্য। তবু উকিল না-জোটায় অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে সোজা জেলে পুরেছে পুলিশ। এতেই শেষ নয়। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে ধৃত সেই বাপি পালকে মালদহের পুলিশ যে ভাবে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তাতে খোদ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘিত হয়েছে বলে এ বার অভিযোগ উঠল। যা প্রকারান্তরে আইনরক্ষকদের ‘অতি সক্রিয়তা’র দিকেই আঙুল তুলছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

হাতকড়া পরিয়ে বাপি পালকে চাঁচল আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।—ফাইল চিত্র।

ধারা ছিল জামিনযোগ্য। তবু উকিল না-জোটায় অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে সোজা জেলে পুরেছে পুলিশ। এতেই শেষ নয়। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে ধৃত সেই বাপি পালকে মালদহের পুলিশ যে ভাবে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তাতে খোদ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘিত হয়েছে বলে এ বার অভিযোগ উঠল। যা প্রকারান্তরে আইনরক্ষকদের ‘অতি সক্রিয়তা’র দিকেই আঙুল তুলছে।

Advertisement

এবং এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি থেকে শুরু করে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও রাজ্যের মানবাধিকার কর্মীদের একটা বড় অংশ উল্লেখ করছেন চৌত্রিশ বছর আগে দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশটির কথা। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া অভিযুক্তকে হাতকড়া পরানো যাবে না। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেও হাতকড়া পরাতে হলে কোর্টের আগাম অনুমতি লাগবে। এই মহলের বক্তব্য, ১৯৮০-র নির্দেশটি এখনও বহাল। তা সত্ত্বেও বুধবার বাপিকে হাতকড়া পরিয়ে রাজ্যের পুলিশ যে শুধু শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে তা-ই নয়, মানবাধিকার-বিধিরও তোয়াক্কা করেনি।

সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় ও অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, ফেসবুকে অশ্লীল মন্তব্যের যে অভিযোগে বাপি পালকে ধরা হয়েছে, তা ব্যতিক্রমী অপরাধ নয়। উপরন্তু বাপির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৬(এ) ও ৬৭ নম্বর ধারা দু’টি বিলক্ষণ জামিনযোগ্য। ফলে অভিযুক্তকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ সর্বোচ্চ আদালতকে অমান্য করেছে বলেই তাঁদের অভিমত। প্রসঙ্গত, বিচারপতি মুখোপাধ্যায় ও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় দু’জনেই পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন। সহমত কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর পর্যবেক্ষণ, পুলিশ আদালত অবমাননার মতো গুরুতর অপরাধ করেছে।

Advertisement

তবে এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত মানবাধিকার কমিশন সরাসরি হস্তক্ষেপ করে থাকে। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তারা পুলিশের কাছে কৈফিয়ৎ তলব করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র কিংবা জঙ্গলমহলের শিলাদিত্য চৌধুরীর পুলিশি হেনস্থার ঘটনায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশন তা-ই করেছিল। অথচ বাপি’র ক্ষেত্রে দু’ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও (জামিনযোগ্য ধারা সত্ত্বেও জেল ও হাতকড়া) কমিশনের এখনও কোনও হেলদোল নেই। কেন?

জানার জন্য ফোন করা হয়েছিল কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসের জবাবও দেননি। দেখে-শুনে কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “রাজ্যে এখন মানবাধিকার কমিশন বলে কিছু নেই। তাই পুলিশের এ সব বাড়াবাড়ি দেখারও কেউ নেই। পুলিশ যা ইচ্ছে, তা-ই করে চলেছে!” রাজ্য পুলিশ কি তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথা জানত না?

মালদহের সংশ্লিষ্ট হরিশচন্দ্রপুর থানার পুলিশকর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁরা উপরওয়ালার নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র। কোন ‘উপরওয়ালা’ এমন আদেশ দিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য কর্তাদের মুখে কুলুপ। মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করবেন না। এসপি তবু ফোন ধরেছেন। কিন্তু কলকাতায় রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি সারা দিন তা-ও ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশটির কথা তো সব থানার জানা উচিত! জেলা পুলিশের আচরণের ব্যাখ্যা কেন চাওয়া হল না, বুঝতে পারছি না।”

সুপ্রিম কোর্টের হাতকড়া-নির্দেশের প্রেক্ষাপট কী ছিল?

আদালতের নথি বলছে, তিহাড় জেলের জনৈক বিচারাধীন বন্দি প্রেমশঙ্কর শুক্ল জেল থেকে সুপ্রিম কোর্টকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে হাতকড়া নিয়ে নালিশ জানিয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দেন, ১৯৭৮-এ সুনীল বাত্রা বনাম দিল্লি প্রশাসনের মামলায় শীর্ষ আদালতের নির্দেশ ছিল, হিংসাত্মক ও পলায়নপ্রবণ বন্দি ছাড়া কাউকে হাতকড়া পরানো বা শিকলে বাঁধা যাবে না। ‘তবু আমাকে ও আমার মতো কিছু বন্দিকে কোর্টে হাজির করানোর সময়ে পুলিশ হাতকড়া পরাচ্ছে।’ টেলিগ্রামে অভিযোগ করেন তিনি। তারই ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট ওই নির্দেশ দেয়।

তার পরেও মালদহ পুলিশের এ হেন আচরণের পিছনে সরকারের অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রতিফলন দেখছেন মানবাধিকার কর্মীদের একাংশ। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সহ সভাপতি রঞ্জিত শূরের কথায়, “এতে সরকারের হিংস্র মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে।” এপিডিআরের আরও দাবি: বাপি-কাণ্ডে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের আর একটা নির্দেশও অমান্য করেছে। ওঁরা বলছেন, অসীম ত্রিবেদী ও বাল ঠাকরেকে নিয়ে মন্তব্য করায় মুম্বইয়ে দুই কিশোরী গ্রেফতার হয়। তার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৬৬(এ) ধারায় আপাতত কাউকে গ্রেফতার করা চলবে না। ধারাটি পুনর্বিবেচনা করতেও বলেছিল সর্বোচ্চ আদালত।

এমতাবস্থায় এপিডিআরের দাবি, অবিলম্বে বাপি পালের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তি দিতে হবে। সংগঠনের এ-ও বক্তব্য: বাপিকে যদি এ ভাবে গ্রেফতার করা হয়, তা হলে তৃণমূলের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর আন্দোলন সম্পর্কে যে মন্তব্য (মদ, গাঁজা, চরস বন্ধ। তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ!) ফেসবুকে করেছিলেন, তাতে তাঁর বিরুদ্ধেও একই ধারা প্রয়োগ করা উচিত!

রাজ্য প্রশাসন অবশ্য অভিষেকের মন্তব্যকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement