বেপরোয়া লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়লেন চন্দন

আন্দোলনকারীরা তখন পিছু হটতে শুরু করেছেন। তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। আর কিছুটা গেলেই রেল মিউজিয়ামের সামনে বাম কৃষক সংগঠনের তৈরি অস্থায়ী শিবির।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৮
Share:

ভ্যানরিকশায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আহত চন্দনকে। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

আন্দোলনকারীরা তখন পিছু হটতে শুরু করেছেন। তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল পুলিশ বাহিনী। আর কিছুটা গেলেই রেল মিউজিয়ামের সামনে বাম কৃষক সংগঠনের তৈরি অস্থায়ী শিবির। সেখান থেকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে, ‘আমাদের অনুমতি নেওয়া আছে। পুলিশ বন্ধুরা দয়া করে এই শিবিরে আঘাত হানবেন না’। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর ৩টে ছুঁইছুঁই।

Advertisement

এ পর্যন্ত সব শান্তই ছিল। কিন্তু হঠাৎই ফোরশোর রোডের তেলকল ঘাটের সামনে জটলা করে থাকা বিক্ষোভকারীদের দিকে লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করল পুলিশ। শুরু হল বেপরোয়া লাঠিচার্জ। এক বিক্ষোভকারী যুবককে টানতে টানতে নিয়ে গেল পুলিশ। সেই সময় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে জল-বিস্কুট খাচ্ছিলেন বর্ধমান শহরের আমড়াতলার বাসিন্দা ও রায়না শ্যামসুন্দর কলেজের সংস্কৃত অনার্সের পড়ুয়া চন্দন রায়। তিনি বর্ধমান জেলা এসএফআইয়ের সদস্য। মাসতুতো দাদা সমর্পণ গুপ্তের সঙ্গে হাওড়ায় এসেছিলেন নবান্ন অভিযানে অংশ নিতে। চন্দনের সঙ্গেই ছিলেন তাঁর প্রতিবেশী সুজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘পাড়ার একটা ছেলেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে এগোতে যাই। তখনই মূর্তিমান পুলিশের সামনে পড়ে যাই।’’

পুলিশের তাড়া খেয়ে হাত থেকে জলের বোতল ফেলে পড়িমড়ি দৌড়তে শুরু করেন সুজিত ও চন্দন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে চালানো লাঠির আঘাত থেকে বাঁচতে আলাদা হয়ে পড়েন ওই দুই যুবক। হাতজোড় করে চন্দন পুলিশকে বলেন, ‘‘জল খাচ্ছিলাম স্যার। চলে যাচ্ছি।’’ সেই আর্তি উপেক্ষা করেই উর্দিধারীদের লাঠি এসে পড়ে বছর ঊনিশের চন্দনের পিঠে, কোমরে। উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে ফুটপাথেই লুটিয়ে পড়েন চন্দন। তাঁকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে আসেন সুজিত। অবস্থা বেগতিক বুঝে কয়েক জন পুলিশ কর্মী চন্দনকে তুলে দাঁড় করানোর চে‌ষ্টা করেন। সুজিতের কথায়, ‘‘চন্দন তাতেও এলিয়ে পড়লে তাঁকে মাড়িয়েই চলে যান কয়েক জন পুলিশকর্মী।’’

Advertisement

রেল মিউজিয়ামের সামনে কৃষকসভার শিবিরে তখন দলে দলে বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে পুলিশও দাঁড়িয়ে। কিন্তু শিবির থেকে কার্যত ঢিল ছোড়া দূরত্বে তখন ফুটপাথের উপর পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন চন্দন। কোনও রকমে বলার চেষ্টা করছেন, ‘‘নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে বাঁচাও।’’ অসহায় ভাবে সুজিতও তখন ‘‘হেল্প-হেল্প, একটু জল দিন’’ বলে চিৎকার করে চলেছেন।

কিন্তু কে শোনে কার কথা! অগত্যা চন্দনকে কোলে তুলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করেন সুজিত। তিনি দু’পা করে এগোন, আর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বারবার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন চন্দন। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে যান কয়েক জন পথচারী। দু’তিন জন পুলিশ কর্মীও। জল নিয়ে আসেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। চন্দনের কোমরে ঠান্ডা জল দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও তাঁর ছটফটানি কমছে না। বার বার বলেই চলেছেন, ‘‘আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা।’’

শেষমেশ তাঁকে কাঁধে তুলে নেন সুজিত। তবু এগোতে পারেন না। ফের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন চন্দন। পথচলতি এক মোটরবাইক আরোহীকে দাঁড় করিয়ে কয়েক জন পথচারী ও সুজিত অনুরোধ করেন চন্দনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তিনি যেতে রাজি হলেও ভিড়ে আটকে যায় মোটরবাইক। ফের ফুটপাথে শুইয়ে দেওয়া হল আচ্ছন্ন ওই যুবককে। রীতিমতো ভয় পেয়ে তাঁর বুকে ‘পাম্প’ করতে শুরু করেন সুজিত। ওই সময় তেলকল ঘাটের দিকে আসা একটি মাল বোঝাই ভ্যানরিকশাকে দাঁড় করিয়ে তাতেই তুলে দেওয়া হয় চন্দনকে। ভ্যান ছোটে শিবিরের দিকে।

শিবিরের কাছে রিকশা পৌঁছতেই দেখা যায়, ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছেন চন্দন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় হাওড়া জেলা হাসপাতালে। সেখানে তাঁকে অক্সিজেন-স্যালাইন দেওয়া হল। পরে বুকের এক্সরে করে তাঁকে আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত করেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় সন্ধ্যায় সিপিএম নেতৃত্ব তাঁকে হাওড়া ময়দানের এক নার্সিংহোমে ভর্তি করে দেন। রাতে ফের তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় আন্দুলের এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, যুবকের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এ দিন রাতে বর্ধমানে চন্দনের বাড়িতে গেলে আত্মীয়েরা তাঁর বাবা-মাকে এই খবর দিতে বারণ করেন। চন্দনের বাবা নারায়ণ রায় সব্জি বিক্রেতা। মা টুকটুকিদেবী অসুস্থ। আত্মীয়েরা জানান, চন্দনের মূল বাড়ি রায়নায়। তবে বড়বাজারের এই বাড়িতেই বাবা-মা থাকতেন। চন্দন নিজে বেশির ভাগ সময়ে ভাতছালায় তাঁর মাসির বাড়িতে থাকতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন