‘সাজা’ কাটছে না, আক্ষেপ চাষির

একটি আত্মহত্যার ঘটনা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শস্যগোলা বর্ধমানে ঠিকা-চাষিদের অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!

Advertisement

সৌমেন দত্ত

রায়না শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৬ ০২:৩৪
Share:

ক্ষতির কথা বলতে ব্যস্ত মৃত শ্রীকান্তবাবুর স্ত্রী-মেয়ে। ছবি-উদিত সিংহ।

একটি আত্মহত্যার ঘটনা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শস্যগোলা বর্ধমানে ঠিকা-চাষিদের অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!

Advertisement

বোরো মরসুমে জমি মালিকদের কাছ থেকে চুক্তিতে জমি নিয়ে প্রান্তিক চাষি বা খেত মজুমদের চাষ করা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে এ জেলায়। অলিখিত নিয়ম হল, চাষ শুরুর আগে বিঘে প্রতি চার হাজার টাকা হিসেবে জমি মালিককে ভাড়া মিটিয়ে দিতে হবে। চাষের বাকি খরচও চাষির নিজস্ব। চুক্তি-চাষিদের দাবি, সব মিলিয়ে বিঘে প্রতি চাষের খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার টাকা। কিন্তু গত বারে তো বটেই এ বারেও ঋণের ভার কমাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় চাষিরা।

চুক্তিতে জমি নিয়ে এ চাষকে ‘সাজা’ বলেন রায়না ও আশপাশের কিছু এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা ও জলের অভাবে বোরো ধানের ফলন এ বার বেশ খানিকটা কমেছে। ফলে গত বারের তুলনায় দাম বেশি থাকলেও চাষের খরচ চোলা মুশকিল হয়ে পড়ছে বলে তাঁদের দাবি। এই পরিস্থিতিতেই বুধবার রায়নার নাদাল গ্রামের ঠিকাচাষি শ্রীকান্ত মালিক আত্মঘাতী হন। তাঁর পরিবারের দাবি ছিল, চাষে ক্ষতির আশঙ্কাতেই শ্রীকান্তবাবু কীটনাশক পান করে আত্মঘাতী হয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, মাটির বাড়ি রন্ধ্রে রন্ধ্রে হতদরিদ্র চেহারা ফুটে উঠছে। দু’কামরার বাড়ির সামনেই গোয়াল ঘর। এক চিলতে উঠোনে ডাঁই করে রাখা খড়ের বোঝা। শ্রীকান্তবাবুর স্ত্রী গায়ত্রীদেবীর দাবি, “এলাকা ঘুরলেই জানতে পারবেন, এ বছর একদমই ফলন হয়নি। আমাদের মতো সাজা নিয়ে যাঁরা চাষ করেছেন, তাঁদের ঘরে হাহাকার। চাষের ক্ষতি সামলানো সোজা কথা নয়।” পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শ্রীকান্তবাবু কাঠ কেটে জীবন চালাতেন। তিন বছর আগে স্থানীয় এক চাষির কাছে ১০ কাঠা জমি ‘সাজা’ নিয়ে প্রথম চাষ শুরু করেন। গত বছর এক বিঘে জমিতে চাষ করেছিলেন, আর এ বার তিন বিঘে জমিতে। গায়ত্রীদেবী বলেন, “গত বারেও চাষে লোকসান হয়েছিল। এ বার সে জন্য চাষ করতেই নিষেধ করেছিলাম। চাষে ক্ষতি হতেই আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। তার জন্য আমার এত বড় ক্ষতি হবে ভাবতেও পারিনি।” তাঁর মেয়ে সরমা দাসও বলেন, “সাজা চাষিদের ক্ষতি হলে ঘুরে দাঁড়ানো খুবই মুশকিল।”

Advertisement

বর্ধমান শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে রায়নার দলুইবাজার। সেখান থেকে সরু পিচ রাস্তা ধরে আরও কয়েক কিলোমিটার গেলে নাদাল গ্রাম। পুরো রাস্তা জুড়ে দেখা গেল, জমির ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোথাও জমির ধারেই ধান ঝাড়ার কাজ চলছে। চাষিরা জানালেন, যেখানে গড়ে বিঘে প্রতি ১৬ বস্তা (৬০ কেজির বস্তা) ধান উৎপাদন হয়, এ বার সেখানে গড়ে ৭-৮ বস্তা ধান উৎপাদন হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা অরূপ শী বলছিলেন, “যাঁরা সাজা-চাষ করেছেন, তাঁদের মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতেই হয়েছে। ফলন কম হওয়ায় তাঁরা ঋণও সম্পূর্ণ শোধ করতে পারবে না, আবার পেটে খাবার জন্যেও ধান ঘরে রাখতে পারেননি।”

চাষের খরচের হিসেব দিতে গিয়ে চাষিরাও জানান, জমি ভাড়া বাবদ ৪০০০ টাকা, জল কিনতে খরচ হয়েছে ১৫০০ টাকা। ধান রোয়া থেকে কাটা পর্যন্ত ২৮ জন মজুরের জন্য খরচ হয়েছে ৫৬০০ টাকা, এর সঙ্গে রয়েছে কীটনাশক, চাপান দেওয়া এবং জমি থেকে ধান তোলার খরচ। সব মিলিয়ে গড়ে ১২ হাজার টাকা বিঘে প্রতি খরচ হয়েছে। রায়নার শঙ্করপুর গ্রামের চাষি সাবের আলি বলেন, “আমাদের দিকে বিঘেতে ১০-১২ বস্তা ধান মিলেছে। প্রতি বস্তা ধানের দাম গড়ে ৮৫০ থেকে ৮৭০ টাকা। ফলে আমাদের মতো চাষিদের ধান বিক্রি করে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। সাজা চাষিদের ক্ষতির বহরটা আরও বেশি।” নাদাল গ্রামেরই ঠিকা-চাষি শক্তি হাজরা, জিতেন হাজরারা বলেন, “জমি বাবদ যে টাকা মালিককে দিতে হয়েছে, সেই টাকাটাই লোকসান।” রায়নার সগড়াই মোড় থেকে কিছুটা এগোতেই বসন্ত দাস, শ্যামল রুইদাসরা ধান ঝাড়ছিলেন, তাঁরা বলেন, “সরকার ধান কিনতে এখনই শিবির না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।”

সেই ইঙ্গিতই মিলছে রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি তৃণমূলের বিদ্যুৎ সাঁতরার কথায়। তিনি বলেন, “জলের অভাবে এ বার ধানের ফলন মার খেয়েছে। অনেক জমিতে ধানের ফলনই তো হয়নি। সাজা-চাষিদের অবস্থা সত্যিই খারাপ।” বর্ধমানের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইল বলেন, “গোটা পাঁচেক শিবির চলছে জেলায়। আরও শিবির বাড়ানোর জন্য দ্রুত চেষ্টা করা হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন