বাগানে দাঁড়িয়ে গঙ্গাধরবাবু। নিজস্ব চিত্র।
বাড়িতে ঢুকলেই নজরে পড়ে থরে থরে সাজানো বেশ কয়েকটি ড্রাম। কী হচ্ছে সেখানে? — চাষি বলেন, ‘জৈব সার।’
গতানুগতিক পদ্ধতিতে ধান, পাট চাষে লাভের নিশ্চয়তা নেই। রাসায়নিকের ব্যবহার নষ্ট করছিল মাটির উর্বর শক্তি। এরপরেই বছর পাঁচেক আগে ‘বিকল্প চাষ’ শুরু করেন পূর্বস্থলী ১ ব্লকের চণ্ডীপুর গ্রামের চাষি গঙ্গাধর হাজরা। তাঁর দাবি, বিকল্প চাষের ফলে বছর বছর ঘরে উঠছে মোটা অঙ্কের লাভ।
হাজরা বাড়ির সদস্যরা জানান, পাঁচ বছর আগে জমিতে শুধু ধান চাষই করা হতো। মোটা টাকায় কিনতে হতো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। ধান বিক্রি করে তেমন লাভ না হওয়ায় মহাজনের ঋণ শোধ করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। এমনকী, খেতমজুরদের কাছেও অনেক সময়ে হাত পাততে হয়েছে বলে জানান গঙ্গাধরবাবু।
এরপরেই গঙ্গাধরবাবু এক কৃষি বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হন। কল্যাণীর মদনপুর থেকে কেঁচো নিয়ে এসে ঘরেই শুরু হয় জৈব সার বানানো। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। যে পরিমাণ কেঁচো সার মিলল, তাতে চাষ হবে না। এ বার বর্ধমান সদরের প্রাক্তন মহকুমাশাসক স্বপন কুণ্ডু কম্পিউটারের মাধ্যমে গঙ্গাধরবাবুকে বুঝিয়ে দিলেন, কী ভাবে তৈরি করতে হবে তরল জৈব সার।
তারপরে বাড়িতে বেশ কয়েকটি ড্রামে করে জল, গোমুত্র, গোবর, চিটে গুড়, বেসন, পাকা কলা, রাসায়নিক মুক্ত মাটি মিশিয়ে গঙ্গাধরবাবু তৈরি করে ফেললেন তরল জৈব সার। গোমুত্র, নিমপাতা, রসুন, কাঁচালঙ্কা, মোতিহার মিশিয়ে তৈরি হল কীটনাশক স্প্রে’ও। কিন্তু এত সবের জোগান কোথা থেকে মিলছে? গঙ্গাধরবাবু জানান, দেবব্রত ঘোষ নামে এক পড়শির খাটাল থেকে প্রাথমিক ভাবে গোবর, গোমূত্র মেলে। এ ছাড়া বাড়ির প্রায় ২৫০টি পোষা ভেড়া মল মুত্রও জৈব সার হিসেবে জমি তৈরির কাজে লাগানো হয়।
জমি তৈরির পরে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে গঙ্গাধরবাবু হুগলির শেওড়াফুলি থেকে পেঁপে, হাওড়া থেকে চাইনিজ মাকড়া বেগুনের উচ্চ ফলনশীল বীজ এনেছেন। ২০১৫ সালে নদিয়ার রানাঘাট থেকে আনেন কুলের চারা। বর্তমানে ৮ বিঘে জমিতে পেয়ারা, পেঁপে ও বেগুন ৩ বিঘে করে, পাতিলেবু ২ বিঘে এবং আড়াই বিঘে করে জমিতে কচুর লতি ও সেগুন গাছ রয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে পেঁপে গাছ লাগানো এবং পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ, ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে ধান চাষেরও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
জৈব সার ব্যবহারের ফলও মিলেছে হাতেনাতে। গঙ্গাধরবাবুর দাবি, জমিতে এখন কেঁচো-সহ বেশ কিছু বন্ধু পোকাদের দেখা যাচ্ছে। বেড়ছে মাটির উর্বরা শক্তিও। এ ছাড়া বিঘা প্রতি জমিতে রাসায়নিক সার ও গতানুগতিক পদ্ধতিতে চাষের তুলনায় খরচ প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে বলেও গঙ্গাধবাবুর দাবি।
ফসল, সব্জি বিক্রির ক্ষেত্রেও ফড়েদের উপরে নির্ভর করেন না তিনি। বরং মোটরভ্যানে করে উৎপাদিত ফসল, সব্জি নিয়ে সমুদ্রগড়, নবদ্বীপে বিক্রি করে আসেন। গঙ্গাধরবাবুর দাবি, নবদ্বীপের বাজারে পাকা পেঁপে প্রতি কিলোগ্রাম ৩০ টাকা দরে বিক্রি করে এসেছেন। কলকাতা ও লাগোয়া বাজারে পেঁপের দর আরও বেশি বলে জানান তিনি। পূর্বস্থলীর এই চাষির দাবি, বিকল্প চাষ করে বিঘা প্রতি জমির হিসেবে পেঁপে ও পেয়ারা উভয় ক্ষেত্রেই ৪০ হাজার টাকা করে লাভ হয়েছে।
বিকল্প চাষ করে ২০১২-১৩ আর্থিক বর্ষে মিলেছে সাফল্যের স্বীকৃতি, ‘কৃষকরত্ন’ পুরস্কার। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিশেষজ্ঞ বিশ্বপতি মণ্ডল ও দীপক ঘোষ প্রশংসাও করে যান গঙ্গাধরবাবুর চাষের। বর্ধমানের এক সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘আদর্শ চাষি হিসেবে নিজেকে বিস্তারিত করেছেন গঙ্গাধরবাবু। ওনার সাফল্য আগামী দিনে বহু চাষিকে পথ দেখাবে।’’
গঙ্গাধরবাবুর সাফল্য দেখে ইতিমধ্যেই গ্রামের বিকল্প চাষ করতে শুরু করেছেন বলে জানান চণ্ডীপুরের বাসিন্দা গোলক দাস। নিজের সাফল্যে খুশি গঙ্গাধরবাবুও বলেন, ‘‘এখন অনেকেই পরামর্শ নিতে আসেন। বাড়ির একতলাটা যখন ঝাঁ চকচকে দোতলা হয়ে যাবে, তখন বোধহয় বিকল্প চাষের পথে আরও বেশি করে চাষিরা হাঁটবেন।’’