Chain-Killer

প্রথম মামলায় ‘চেন-খুনি’র ফাঁসির সাজা

বছর বিয়াল্লিশের কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে গোটা ষোলো মামলা রয়েছে। কালনার সিঙেরকোনে বছর পনেরোর এই নাবালিকার উপরে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে খুনই ছিল তার গ্রেফতার হওয়ার আগে শেষ ঘটনা।

Advertisement

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

কালনা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০ ০২:৩১
Share:

কামরুজ্জামান সরকার। ফাইল ছবি

নাবালিকাকে যৌন নির্যাতন করে খুনের দায়ে ‘চেন-খুনি’র মৃত্যুদণ্ড দিল আদালত। সোমবার কালনা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক তপনকুমার মণ্ডল এই ঘটনাকে ‘বিরলতম’ আখ্যা দিয়ে দোষী কামরুজ্জামান সরকারের ফাঁসির আদেশ দেন। এ ছাড়া, মৃত নাবালিকার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা আইনি পরিষেবা কেন্দ্রকে। শতাব্দী প্রাচীন কালনা আদালতে এ নিয়ে দ্বিতীয় বার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হল।

Advertisement

বছর বিয়াল্লিশের কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে গোটা ষোলো মামলা রয়েছে। কালনার সিঙেরকোনে বছর পনেরোর এই নাবালিকার উপরে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে খুনই ছিল তার গ্রেফতার হওয়ার আগে শেষ ঘটনা। গত বৃহস্পতিবার এই মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। সোমবার সাজা ঘোষণার জন্য ১১টা নাগাদ কালনা উপ-সংশোধনাগার থেকে কামরুজ্জামানকে আদালতের পুলিশ লক-আপে আনা হয়। পরনে ছিল লুঙ্গি ও রংচটা জামা। দুপুর পৌনে ১টা নাগাদ তাকে আদালতে তোলা হয়।

আইনজীবীরা জানান, বিচারক প্রথমেই জানিয়ে দেন, মামলায় ৩৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলা চলাকালীন কোন-কোন দিকে আদালত গুরুত্ব দিয়েছে এবং খুন, ধর্ষণ-সহ যে পাঁচটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সেগুলিতে কী-কী শাস্তির বিধান রয়েছে, সে সব ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কামরুজ্জামান আদালতে দাবি করে, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এর পরে তার আইনজীবী অরিন্দম বাজপেয়ী আদালতে দাবি করেন, তার মক্কেল ওই বাড়িতে ঢুকেছিল, তার জোরাল প্রমাণ মেলেনি। কামরুজ্জামানের পরিবারে সে একমাত্র রোজগেরে ছিল। এখন তার স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ের কষ্টে দিন কাটছে। সব দিক বিবেচনা করে কম সাজা দেওয়ার আর্জি জানান তিনি। তবে সরকারি আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহা দেশের কয়েকটি মামলার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এই মামলাটিকে ‘বিরল থেকে বিরলতম’ দাবি করে সর্বোচ্চ সাজার আর্জি জানান।

Advertisement

অঘটন-পঞ্জি

১ জানুয়ারি, ২০১৩: স্বামী হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে দেখেন ধাত্রীগ্রামের বাড়িতে গলায় চেন পেঁচিয়ে খুন স্ত্রী।

২৭ জানুয়ারি, ২০১৩: পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বাড়ির সবাই। রাতে ফিরে দেখেন গলায় চেন পেঁচানো দেহ পড়ে মহিলার।

১৯ মার্চ, ২০১৩: কালনার কদম্ব সরকার এলাকায় এক মহিলাকে খুনের চেষ্টা।

৪ অক্টোবর, ২০১৮: কালনা ২ ব্লকের শিবরামপুর এলাকায় মহিলার উপরে হামলা। কোনও রকমে প্রাণে বাঁচেন তিনি।

২৭ জানুয়ারি, ২০১৯: কালনা ২ ব্লকের আনুখালে গলায় চেন, গামছা পেঁচিয়ে খুন মহিলা।

১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯: মিটার দেখার নামে কালনা ১ ব্লকের উপলতি গ্রামের বৃদ্ধাকে চেন পেঁচিয়ে খুনের চেষ্টা।

১ এপ্রিল, ২০১৯: কালনা ১ ব্লকের ধর্মডাঙা গ্রামে মিটার দেখার নামে ঢুকে অল্পবয়সী বধূকে চেন পেঁচিয়ে খুনের চেষ্টা।

২ এপ্রিল, ২০১৯: মেমারির বড়া গ্রামে মাথায় আঘাত করে মহিলাকে খুন। একই দিনে মেমারির সেগুনবাগানেও একাকী মহিলাকে খুন।

২২ মে, ২০১৯: কালনা ১ ব্লকের হাটকালনায় অর্ধনগ্ন দেহ মহিলার। গলায় গামছা পেঁচানো।

২৭ মে ,২০১৯: মন্তেশ্বরের শ্যামনবগ্রামে বাড়িতে একাকী মহিলাকে গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে খুন। যে মামলায় সাজা

৩০ মে, ২০১৯: কালনা ২ ব্লকের সিঙেরকোনে নাবালিকার উপরে হামলা। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মারা যায় ওই তরুণী।

(** এই মামলাগুলি ছাড়াও হুগলির পাণ্ডুয়া এবং বলাগড় এলাকার আরও তিনটি মামলা রয়েছে কামরুজ্জামানের নামে।)

দু’পক্ষের কথা শুনে অল্প সময়ের জন্য আদালত কক্ষ ছেড়ে যান বিচারক। তার পরে দুপুর ১টা ১৬ মিনিট নাগাদ ফিরে এসে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারক জানান, সাধারণ মানুষ থেকে পশুপাখি, সকলেই তার বাড়িকে নিরাপদ আশ্রয় ভাবে। বাড়িতেই এক নাবালিকাকে নিষ্ঠুর ভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। চিকিৎসকদের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে নিষ্ঠুরতার কথা। সামজিক তাৎপর্য থাকা ঘটনাটিকে তিনি ‘বিরলতম’ বলে মনে করেছেন।

রায় ঘোষণার পর বিচারক কামরুজ্জামানকে জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে সে উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে। নিজে আইনজীবী নিয়োগ করে লড়াই করতে পারে বা সরকারি সহায়তা চাইতে পারে। কামরুজ্জমান জানায়, মামলা লড়তে সরকারি সহায়তা চাইবে সে। তার আইনজীবী অরিন্দমবাবু পরে জানান, তাঁরা উচ্চ আদালতে আবেদনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন।

সরকার পক্ষের আইনজীবী সৌম্যজিৎবাবু বলেন, ‘‘মাত্র ১৫ বছরের একটি মেয়ের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তার উপরে পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে খুন করা হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা সমাজব্যবস্থার সুস্থ ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। এ দিনের সাজা এ রকম অপরাধ করার আগে কাউকে ভাবতে বাধ্য করবে।’’ জেলা পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটি বিরলতম ঘটনা। মামলায় বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রামাণ্য নানা তথ্য আদালতে পেশ করা হয়েছিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন