এখানেও বিকল্প রয়েছে, কিন্তু ব্যবহার হবে কি

দারিদ্র, চাকরি হারানো, এ সবের সঙ্গে এই জেলা বরাবরই পরিচিত। এই অনিশ্চয়ত সময়ে বিকল্প কী হতে পারে? এই জেলার সম্পদকে যথাযথ ব্যবহার করলে তা-ও কিন্তু সম্ভব। আর সেটা সম্ভব হলে হাহাকার কমবে, কমবে রাজ্য সরকারের উপরে তৈরি হওয়া চাপও।

Advertisement

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২০ ১০:২০
Share:

নিজস্ব চিত্র।

‘পাতাল রেল তো অনেক দূরে/ তার আগে তো পাতাল দেশেই আসবে/ জীবন যাদের এমনি গতিহারা/ তাদের পানে একটু ফিরে চাইবে।’ (বিমলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়) — ‘লকডাউন’-পর্বে এই চাওয়া না-চাওয়া, পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবের খোঁজ করতে গিয়ে কলম জুড়ে শুধুই আঁধার গড়িয়ে পড়ে। সপ্তম শ্রেণির ভূগোল ক্লাসে অমিয় মাস্টার ব্ল্যাকবোর্ডে যত্ন করে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র আঁকতেন। তার পরে, রুমালে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এই এলাকাটি আলাদা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করতেন। দৃঢ় স্বরে বলতেন এই হল আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল— ‘ভারতবর্ষের রুঢ়’।

Advertisement

করোনা-মানচিত্রে কর্মহীন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ-কথা শুনতে শুনতে এই রুঢ়ের ক্রমে রুখা হওয়ার কঠিন বাস্তবটা মনে পড়ে— সাইকেল, অ্যালুমনিয়াম, পেপার মিল, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড-সহ একের পরে এক কারখানার চিমনির ধোঁয়া ওঠা অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ‘রুঢ়’ হয়ে উঠল যেন ‘চোখের জলের উপত্যকা’। আজ করোনা-গ্রাসে কাজ হারানোর পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিসংখ্যান যখন আসছে, শিল্পাঞ্চলের স্মৃতিতে তখন ভাঙনের নাভিশ্বাস। ক্রমে শুকিয়ে যাচ্ছে অজয়, দামোদর-সহ জেলার জলের মূল উৎসগুলি।

অথচ, এমনটা হওয়ার কি হওয়ার কথা ছিল? ১৭৭৪-এ চিনাকুড়ির কাছে কয়লা তোলা, ১৮৫৫-য় রেল চলাচল, ১৯৭৩-এ কয়লাশিল্পের জাতীয়করণ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বেসরকারি কয়লাক্ষেত্র, সরকারি মালিকানা, যৌথ উদ্যোগ, বেআইনি উৎপাদন— সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের আড়াইশো বছরের শিল্প-ইতিহাস, উন্নয়নের ফলিত অর্থনীতি! অর্থনীতি দুর্গাপুর থেকে বরাকর, নবগঠিত পশ্চিম বর্ধমান জেলার। কিন্তু ভূগোল, পরিবেশের কথা বেঁচে থাকলে পরে হবে।

Advertisement

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জানিয়েছে, কোভিড ১৯-এর কারণে আগামী তিন মাসের মধ্যে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাঁদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে পারেন। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি হতে পারে! রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই সংস্থারই পূর্বাভাস, ভারতবর্ষে চরম দারিদ্রের খাদে গড়িয়ে পড়তে পারেন অন্তত ৪০ কোটি মানুষ।

কিন্তু দারিদ্র, চাকরি হারানো, এ সবের সঙ্গে এই জেলা বরাবরই পরিচিত। পরিচয় ‘লে অফ’, ‘খাদে চাপা পড়ে মৃত্যু’, ‘ধস’, এই শব্দগুলির সঙ্গেও। কবিও বলেন, ‘বৃন্দাবনের কিষ্ট এখন বনজেমেরির মালকাটা/ বেকার কামিন রাধার এখন হাজরি খাতায় নামকাটা।’ অথচ, ভারতীয় অর্থনীতির নিয়ম, পাটিগণিত মেনেই এই অঞ্চলেও উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয় বেড়েছিল। দূরন্ত গতিতে মুষ্টিমেয় মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ উল্কার গতিতে বেড়েছিল। পাল্লা দিয়ে বেড়েছি অসাম্য, দারিদ্রও। কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গেও এ জেলার পরিচিত অনেক দিনের।

তা হলে, এই অনিশ্চিত সময়ে বিকল্প কী হতে পারে? জরুরি এই জেলার সম্পদকে যথাযথ ব্যবহার। সেই ব্যবহার সুষ্ঠু ভাবে করা সম্ভব হলে হাহাকার কমবে। কমবে রাজ্য সরকারের উপরে তৈরি হওয়া চাপও।

এই অঞ্চলে এখনও ঈর্ষণীয় সংখ্যায় কারখানা, কর্পোরেট, ব্যাঙ্ক, বিমা-সহ নানা ধরনের ছোট-বড় শিল্প রয়েছে। বিস্তীর্ণ ইসিএল-এর কয়লা ক্ষেত্র চোদ্দটি এরিয়ায় বিভক্ত। প্রায় অনেকগুলিতে এরিয়া স্তরে হাসপাতাল আছে। তিনটি বড় হাসপাতাল, সাঁকতোড়িয়া, কাল্লা ও বাঁশড়ায়। রয়েছে ইসকো, ডিএসপি-র হাসপাতাল, রেল হাসপাতাল প্রভৃতি। রয়েছে বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রও। এই সব ক’টি ক্ষেত্রের মধ্যে সমন্বয় তৈরি হলে সঙ্কট-যুদ্ধ অনেকটা সহজ হয়।

দ্বিতীয়ত, ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’-তে কী হয়েছে, তা নিয়ে জেলার বড় অংশের মানুষ অনেকটাই আঁধারে থাকেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বড় শিল্পক্ষেত্রগুলি এই খাতে আরও বেশি টাকা ব্যবহার করতে পারে। তবে জেলা স্বাস্থ্য দফতর, স্থানীয়, জেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়-সেতু তৈরি বাস্তব দাবি।

তৃতীয়ত, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে থেকে আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বেশ কিছু মানুষ বড় উদ্যোগপতি হয়েছেন। প্রকৃতি এখানে কৃপণ নয়। জেলার সম্পদ, শ্রম, পরিবহণ ব্যবস্থার কারণেই তাঁদের উদ্যোগ সফল। এখন আর্তি, তাঁরাও এগিয়ে আসুন। এ ছাড়া এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কয়লা, লোহা আর বালি দীর্ঘ দু’শো বছরের বেশি সময় ধরে একটা সুবিধাভোগী অংশ ব্যবহার করেছেন। সমান্তরাল ‘কালো টাকা’র অর্থনীতি চলেছে। গরিব মানুষের জমি জলের দরে চলে গিয়েছে। কিন্তু এটা একটা সরল পাটিগণিত। আলো-ছায়ার খেলায় কালো অংশই বেশি। এই মানুষগুলিও কি করোনা-সঙ্কটে এগিয়ে আসতে পারেন না? ‘রত্নাকরও যে বাল্মীকি হয়েছিলেন’!

আরও পড়ুন: হাতে চকোলেট, ছাড়া পেলেন দুই করোনা-আক্রান্ত

চতুর্থত, রাজ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তর্গত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আজ যুদ্ধভূমিতে। কিন্তু এর সংখ্যা এই মুহূর্তে প্রয়োজনের তুলনায় কমই। এর বাইরে রয়েছেন নিজস্ব পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদেরও এ সময়ে দূরে থাকলে চলবে না। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁরা দূরে নেইও। এই যৌথ-কর্মের মধ্যেই ঘোষিত হবে প্রত্যয়: ‘মৃত্যুকে তুমি রোধ করতে পারবে না। কিন্তু অকালমৃত্যুকে করবেই’।

আমাদের জেলার আজ যা শক্তি, তাতে আমরা নিজেরাই অনেকটা হলেও জরুরি পরিষেবার ব্যবস্থা করতে পারি। তা হলে সরকারের ভার সামান্য হলেও লাঘব হবে। তবে তা করতে গেলে পরিকাঠামো, বিজ্ঞান, মানবসম্পদ— সবকিছুর মধ্যেই যৌথ-ভাবনাটা জরুরি। এই মুহূর্তে এলাকার দূষণ কম। স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলি বন্ধ আর সুপ্ত বলে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে অনেক দিন পরে। খনি অঞ্চলে খোলামুখ খনিতে ডাঁই করা বর্জ্য-পাহাড়গুলি (‘ওভারবার্ডেন’) জেগে রয়েছে। মাটিতে কয়লার গুঁড়ো উড়ছে না। কাঁচা কয়লা পুড়িয়ে বাজারে পাঠানো যাচ্ছে না, ক’দিন। দু’শতাব্দীর শোষণ-ইতিহাসও খানিকটা স্থবির। এই পরিস্থিতিতেই জরুরি বিকল্পের কাছাকাছি যাওয়ার। কারণ, ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব/ থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে/ প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।’

আরও পড়ুন: স্বামীর মৃত্যু উত্তরপ্রদেশে, গলসিতে আটকে তরুণী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement