মহাকালী আশ্রমের সেই ঘর। ছবি: উদিত সিংহ।
কয়েক মাস তদন্ত করার পরেও ‘খুনি’কে গ্রেফতার তো দূর, মৌনীবাবা খুনের কোনও সূত্রই খুঁজে পাননি বলে আদালতকে জানিয়েছিলেন তদন্তকারী অফিসার। বিচারক ওসিকে তদন্তের ভার দেন। তিনিও কার্যত হাত তুলে দেওয়ায় তদন্তের ভার যায় ডিএসপি পদমর্যাদার এক আধিকারিকের কাছে। আড়াই বছর পরেও খুনের কারণ নিয়ে পুলিশ ধোঁয়াশাতেই।
২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর। হাড়কাঁপানো শীতের রাতে গুলি করে খুন করা হয়েছিল গলসির চান্নাগ্রামের মহাকালী আশ্রমের সন্ন্যাসী কালীপ্রণব ব্রহ্মচারীকে (৬২)। তাঁর ভাইপো ভাতারের কুলনগর গ্রামের বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, ‘আমার ছোট কাকা ৩০ বছর ধরে চান্নাগ্রামের আশ্রমে রয়েছেন। উনি এলাকায় মৌনীবাবা নামে পরিচিত। ওই আশ্রমের একটি ঘরে থাকা বাঁশদ্রোণীর স্বপ্না মজুমদার নামে এক মহিলার বয়ান অনুযায়ী, তিন-চার জন দুষ্কৃতী আশ্রমে ঢুকে আমার কাকাকে গুলি করে।’ তাঁর দাবি, তিনি যখন আশ্রমে পৌঁছন, সেই সময় রক্তাক্ত অবস্থায় দরজার সামনে লুটিয়ে পড়েছিলেন মৌনীবাবা। গ্রামবাসীরা জানান, আশ্রমটি সাধক কমলাকান্তের স্মৃতি বিজড়িত। এখানে থাকাকালীন ১২ বছর ধরে মৌনব্রত পালন করেছিলেন ওই সন্ন্যাসী।
ঘটনার পরপরই পুলিশ বছর বাহান্নর ওই মহিলাকে আটক করে বেশ কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু কোনও সূত্রই মেলেনি। পুলিশের দাবি, মাঝরাতে গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে ওই মহিলার। দরজা খুলে বাইরে এসে তিনি দেখেন, চাদর মাথা মুড়ি দিয়ে দু’জন পালিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করার পরে তাঁর চোখে পড়ে, আশ্রমের ভিতরে কালী মন্দিরের পাশে একটি ঘরে ‘মৌনীবাবা’ রক্তাক্ত অবস্থায় দরজায় ঠেস দিয়ে বসে রয়েছে। তবে সিআইডির স্কেচ-বিশেষজ্ঞদের কাছে ওই আততায়ীদের তেমন কিছু বর্ণনা দিতে পারেননি তিনি। চান্না গ্রামের বাসিন্দাদের যদিও দাবি, ওই মহিলার কথায় অসঙ্গতি রয়েছে। ঘটনার পরেই ওই মহিলা তাঁদের জানিয়েছিল, ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখেন, সিঁদুরের ফোটা লাগানো তিন যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁর কাছ থেকে ওই তিন যুবক পিস্তল দেখিয়ে আলমারির চাবি চেয়েছিল। চাবি নেই শোনার পরে তাঁরা অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়। এরপরে তিনি মৌনীবাবার ঘরে এসে দেখেন, খাটের পায়ার সঙ্গে দড়ি বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছেন ওই সন্ন্যাসী। বুকের দু’জায়গা দিয়ে ও মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
পুলিশ তদন্তে নেমে আরও জানতে পারে, মৃত সন্ন্যাসীর সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। গ্রামবাসীদের চেয়ে বহিরাগতদের আনাগোনা বেশি ছিল মন্দিরে। ওই সময় বর্ধমান জেলা জুড়ে বিভিন্ন মন্দিরে একের পর এক বিগ্রহ থেকে গয়না চুরি হচ্ছিল। পুলিশের ধারণা, মন্দিরের আলমারি ও মৌনীবাবার ঘরে থাকা আলমারিতে দেবীর গয়না ও মোটা অঙ্কের টাকা রয়েছে ভেবেই হামলা চাসায় আততায়ীরা। কিন্তু মাঝরাতে মন্দিরের তালা ভাঙতেই সন্ন্যাসীর ঘুম ভেঙে যায়। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই আততায়ীদের সঙ্গে ওই সন্ন্যাসীর হাতাহাতি হয়। তারপরেই তাঁর বুকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই ওই সন্ন্যাসী প্রাণ হারান। গ্রামবাসীদের একাংশেরও ধারনা, মন্দিরের গয়না লুঠ করতে এসেছিল আততায়ীরা। সেই লুঠে বাধা পাওয়া এবং খুব সম্ভবত পরিচিত হয়ে যাওয়ার জন্যই তাঁকে গুলি করে চম্পট দেয় আততায়ীরা। তবে খুনের কিনারা করার ব্যাপারে গ্রামবাসীদের কোনও ‘চাপ’ ছিল না পুলিশের উপর। এমনকী তদন্তেও সাহায্য করতে কোনও গ্রামবাসী এগিয়ে আসেননি বলেও পুলিশের দাবি। ফলে, মৌনীবাবার মতোই তাঁর খুনের তদন্তও আড়াই বছর ধরে মৌন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনার কয়েক মাস পরে তদন্তকারী অফিসার খুনের কোনও সূত্রই খুঁজে পাননি বলে আদালতকে জানান। ওই রিপোর্ট পেয়ে বর্ধমান জেলা আদালতের বিচারক তৎকালীন ওসিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তিনিও ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে আদালতকে জানান, এই মামলার নতুন করে তদন্তের আর কোনও অবকাশ নেই। তারপরেও বর্ধমানের সিজেএম সেলিম আহমেদ আনসারি গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ডিএসপি পদমর্যাদার এক আধিকারিককে তদন্তের নির্দেশ দেন। ওই বছরের ১৪ মার্চ বর্ধমানের ডিএসপি (অপরাধ) বিচারককে লিখিত ভাবে জানান, গলসির চান্নাগ্রামের মহাকালী আশ্রমের সন্ন্যাসী খুনের তদন্তের ভার তিনি নিচ্ছেন। কিন্তু তার আড়াই বছর পরেও কিনারা হয়নি কোনও।