উদ্বোধন সার, চালুই হয়নি এসএনসিইউ

গ্রামের গন্ধ ঝেড়ে শহরের তকমা গায়ে লেগেছে কবেই, কিন্তু হাসপাতাল এখনও গ্রামীণ। বাসিন্দাদের অভিযোগ, মেমারি গ্রামীণ হাসপাতালে বহির্বিভাগ, অন্তর্বিভাগ, এক্স-রে, অ্যাম্বুল্যান্স, অস্ত্রোপচার থেকে সদ্যজাতদের বিশেষ ইউনিট— সবই রয়েছে, চিকিৎসক-নার্সও রয়েছেন যথেষ্ট, কিন্তু পরিষেবা মেলে না।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

মেমারি শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫ ০১:৫৬
Share:

বাঁ দিকে, পরিষেবা না মেলায় রোগী নেই মেমারি গ্রামীণ হাসপাতালে। ডান দিকে, বন্ধ পড়ে এসএনসিইউ। ছবি: উদিত সিংহ।

গ্রামের গন্ধ ঝেড়ে শহরের তকমা গায়ে লেগেছে কবেই, কিন্তু হাসপাতাল এখনও গ্রামীণ।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, মেমারি গ্রামীণ হাসপাতালে বহির্বিভাগ, অন্তর্বিভাগ, এক্স-রে, অ্যাম্বুল্যান্স, অস্ত্রোপচার থেকে সদ্যজাতদের বিশেষ ইউনিট— সবই রয়েছে, চিকিৎসক-নার্সও রয়েছেন যথেষ্ট, কিন্তু পরিষেবা মেলে না। তাঁদের দাবি, হাসপাতালে অধিকাংশ সময়েই চিকিৎসকদের দেখা মেলে না, এক্স রে মেশিনে নিয়মিত ছবি তোলা হয় না, অ্যাম্বুল্যান্স রোগী নিয়ে আসার বদলে দফতরের কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয়। আর রোগী এলে সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়, ‘রেফার টু বর্ধমান’। অর্থাৎ দু’দশক আগে পুরশহরের তকমা জুটলেও মেমারি এখনও পড়ে রয়েছে মেমারিতেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই বর্ধমান জেলার বাম আন্দোলনের অন্যতম মুখ হরেকৃষ্ণ কোনার, বিনয় কোনারের বাবা শরৎচন্দ্র কোনার মেমারিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ার জন্য উদ্যোগ করেছিলেন। মা গোলাপসুন্দরীদেবীর নামে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন তিনি। চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে ছ’একর জায়গা ও এক লক্ষ দশ হাজার টাকা দানও করেছিলেন। পরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ওই দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্রটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হিসাবে পরিচিতি পায়। সাতের দশকে অজিত পাঁজা স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আরও দু’একর জায়গা জুড়ে মেমারি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। কোনার পরিবারের সদস্য, মেমারির প্রাক্তন পুরপ্রধান অভিজিৎ কোনার বলেন, “১৯৯৫ সালে মেমারি পুরসভা গঠনের পরে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র গ্রামীণ হাসপাতালে উন্নীত হয়।” গ্রামীণ হাসপাতাল গঠনের পরে আরও উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার আশা করেছিলেন মেমারির মানুষ। কিন্তু কুড়ি বছর পরেও স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়নি। বাসিন্দারাই জানান, হাসপাতালের ভেতরের তো বটেই, বাইরের দশাও বেহাল। নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই হাসপাতাল এলাকা জলে থই থই করে। অন্তর্বিভাগ আবার ঝুল, নোংরায় ভরা। তার নীচেই সার দিয়ে রয়েছে রোগীদের শয্যা। এ ছাড়া চিকিৎসকদের দেখা না পাওয়া আর অল্পেই রেফার করে দেওয়ার অভিযোগ তো রয়েইছে। বাসিন্দাদের দাবি, অনেক সময় সামান্য জ্বরজ্বালা হলেও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেন কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা। এই সব কারণেই ৫০ শয্যার হাসপাতালে গড়ে ১২ জনের বেশি রোগী ভর্তি হন না। হাসপাতালের নথি তো বটেই, এলাকার বাসিন্দা সন্ধ্যা দে কিংবা পিয়ালি সাহারাও একই কথা বলেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘যদি সত্যি ভাল চিকিৎসা মিলত তাহলে কী আর হাসপাতালের বেড এ ভাবে ফাঁকা পরে থাকত?” অথচ মেমারি পুরসভা ছাড়াও মেমারির দুটো ব্লকের প্রায় তিন লক্ষ মানুষ এই হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল।

Advertisement

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, রোগীর চাপের তুলনায় পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। ফলে সমস্ত পরিষেবা দেওয়া যায় না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ৯ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৫ জন এবং ২২ জন নার্সের জায়গায় ১৬ জন নার্স বর্তমানে রয়েছেন। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অন্যান্য গ্রামীণ হাসপাতালে এই পরিকাঠামো নিয়েই কাজ চলে গেলেও এখানে তা সম্ভব নয়। কারণ রোগীর চাপ খুব বেশি।’’ তাঁর দাবি, ‘‘প্রতিদিন কয়েক’শো রোগী বহির্বিভাগে আসেন। অন্তর্বিভাগেও ভর্তির চাপ রয়েছে।’’ এ ছাড়া নিয়মিত স্বাভাবিক প্রসব তো হয়ই, সপ্তাহে একদিন (বৃহস্পতিবার) প্রসূতিদের অস্ত্রপচার করা হয় বলেও চিকিৎসকেরা জানান। এলাকার বাসিন্দারা জানান, কয়েক মাস আগেও এই হাসপাতালে নিয়মিত বন্ধ্যাত্বকরণ হত। এক-একদিনে ১২০-২৫ জনেরও বন্ধ্যাত্বকরণের অস্ত্রপোচার হত। কিন্তু এখন খুব বেশি হলে দু’এক জনের দেখা পাওয়া যায়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানিক ভাবে অসাড় করা হয় বলেই মহিলারা এখন আর হাসপাতালমুখী হতে চাইছেন না।

মাস আটেক আগে এই হাসপাতালেই সদ্যজাতদের বিশেষ ষত্নের জন্য সিক নিউনেটাল কেয়ার ইউনিটের উদ্বোধন হয়েছিল। কিন্তু শিশু চিকিৎসকের অপ্রতুলতায় তা চালুই করতে পারেননি হাসপাতালের কর্তারা। এক্স-রে মেশিন, অ্যাম্বুল্যান্স নিয়েও একই অভিযোগ বাসিন্দাদের। রোগীরা জানান, বিধায়ক আবু হাসেম মণ্ডলের তহবিলের টাকায় কেনা অ্যাম্বুল্যান্সটি রোগীদের বদলে হাসপাতালের দফতরের কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয়। ফলে রেফার হওয়া রোগীরা কোনও সুবিধায় পান না। বাধ্য হয়ে বেশি গাড়িভাড়া দিয়ে বর্ধমান যেতে হয় তাঁদের।

Advertisement

ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই হাসপাতালকে মহকুমা হাসপাতালে উন্নীত করার দাবি তুলেছেন বাসিন্দারা। সুর মেলাচ্ছেন বিরোধীরাও। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুকান্ত কোনার এবং এআইসিসির সদস্য সেলিম মোল্লার বক্তব্য, “দিন দিন রোগীদের চাপ বাড়ছে, তার উপর বর্ধমানে দু’টি মহকুমা থাকলেও কোনও মহকুমা হাসপাতাল নেই। ফলে এই হাসপাতালকে মহকুমা হাসপাতালে উন্নীত করা গেলে পরিষেবা বাড়বে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চাপও কমবে।” দাবির সঙ্গে একমত হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা মেমারির বিধায়ক আবু হাসেম মণ্ডলও। তাঁর দাবি, ইতিমধ্যে হাসপাতালটিকে স্টেট জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তার আগে হাসপাতালের গা থেকে ‘গ্রামীণ’ শব্দটা মুছে দেওয়ার জন্যেও বিধানসভায় দাবি করেছেন বিধায়ক।

কেমন লাগছ আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন: ‘আমার শহর বর্ধমান’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp। অথবা চিঠি পাঠান: ‘আমার শহর’ বর্ধমান বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা: ৭০০০০১।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন