চোটপাট: অধ্যক্ষের ঘরে ছাত্রছাত্রীরা। মঙ্গলবার। ছবি: উদিত সিংহ
ভুল কারণে ফের শিরোনামে বর্ধমান রাজ কলেজ। এবং আরও এক বার যাঁর জন্য কলেজকে নিয়ে চর্চা, তিনিই ওই কলেজেরই টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সুরোজ ঘোষ। এ বার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, দলবল নিয়ে অধ্যক্ষ নিরঞ্জন মণ্ডলের ঘরে ঢুকে তাঁর সঙ্গে অশালীন আচরণের। এর আগেও সুরোজের বিরুদ্ধে কলেজের পরীক্ষায় নাক গলানো এবং অধ্যক্ষের সঙ্গে অভব্য আচরণের অভিযোগ উঠেছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষ সুরোজের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন। কিন্তু, এই গোলমালের জেরে সাবেক বর্ধমান (অধুনা পূর্ব বর্ধমান) জেলার অন্যতম সেরা কলেজের নাম ডুবছে বলেই মনে করছেন প্রাক্তনীরা।
কলেজ সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুধু বর্তমান অধ্যক্ষ নিরঞ্জনবাবু নয়, প্রাক্তন টিচার ইন-চার্জ নিরুপমা গোস্বামীকেও ছাত্র সংসদের কোপে পড়তে হয়েছিল। সেই সময় নিরুপমাদেবী তৎকালীন টিএমসিপি ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সিংহের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক চিঠি দিয়ে কলেজের কাজে ‘হস্তক্ষেপ’-এর অভিযোগ জানিয়েছিলেন। ছাত্র সংসদের সদস্যদের ‘দাপাদাপি’ বন্ধ করতে একগুচ্ছ নিয়ম চালু করেছিলেন। তাতেও কাজ না-হওয়ায় ভর্তির সময়ের পাশাপাশি বেশ কিছুদিন কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন করেছিলেন নিরুপমাদেবী।
সেই ‘ব্যাটন’টাই গত বছর ২৩ ডিসেম্বর হাতে নেন নিরঞ্জনবাবু। কলেজের শিক্ষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, তখন থেকেই তাঁকে বেশ কয়েক বার বিপাকে ফেলার চেষ্টা করে ছাত্র সংসদ। প্রথম দিকে নিরঞ্জনবাবুও শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় হাঁটতে চাননি। ‘চুপচাপ’ সহ্য করে নিয়েছিলেন। এক শিক্ষকের কথায়, “কিন্তু, এ বছর ভর্তির সময় ফের কলেজে ছড়ি ঘোরানো শুরু করে ছাত্র সংসদের মাথারা। প্রচুর টাকার লেনদেন হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠে। নিরঞ্জনবাবু চুপচাপ থাকায়, ছাত্র সংসদ ভেবেছিল এ বারও তারা ছাত্র ভর্তিতে নাক গলাবে। কিন্তু সেটা হয়নি বলেই ওদের এত গোসা!” কলেজের আর এক শিক্ষক বলেন, “আর্থিক-দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত চলছে। সেই তদন্ত বন্ধ করার জন্য ছাত্র সংসদকে উস্কানি দিচ্ছেন কোনও কোনও শিক্ষক! তাতে কলেজেরই ক্ষতি হচ্ছে।”
কলেজ সূত্রের দাবি, এ বার ভর্তির সময় বেশ কয়েক বার সুরোজ দলবল নিয়ে ‘অ্যাডমিশন’ রুমে ঢুকে পড়েন। এমনকী ‘ক্যাশ কাউন্টারেও’ চলে গিয়েছিলেন। শক্ত হাতে তাঁদেরকে বের করে দেন অধ্যক্ষ। তার পরেই চলে আসে অনার্স পার্ট-টু পরীক্ষা। তখনও সুরোজ দলবল নিয়ে পরীক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে ‘হস্তক্ষেপ’ করতে থাকেন বলে অভিযোগ ওঠে। অবস্থা এমন হয় যে, পরীক্ষার হলে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন বলে অধ্যক্ষকে হুমকি দেন। অধ্যক্ষ পুলিশ ডাকেন। ছুটে যান কলেজের প্রাক্তনী সংসদের সভাপতি, জেলা তৃণমূলের নেতা উত্তম সেনগুপ্ত। তাঁদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি তখনকার মতো আয়ত্তে আসে। ওই ঘটনার পরেই সুরোজ-সহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করেন অধ্যক্ষ। এ দিনের ঘটনা শুনে উত্তমবাবু বলেন, “একটা নামী কলেজ বারবার ভুল কাজের জন্য আলোচিত হচ্ছে, সেটা ভাল দিক নয়।”
সেই সুরোজের বিরুদ্ধেই মঙ্গলবার দুপুরে দলবল নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে অভব্য আচরণ, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ‘ভয়’ দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সুরোজের বিরুদ্ধে এফআইআর প্রত্যাহার করাই ছিল মূল দাবি। পাশাপাশি ছাত্র সংসদের আরও দাবি, ক্যাম্পাসের ভিতরে গাছ বিক্রি এবং ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। বিল বই চুরির পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা থাকার পরেও মহিলা আবাসে নিয়মিত চুরির ঘটনা ঘটছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন চুপ করে বসে রয়েছেন—এই জবাব চাইতে গিয়ে ছাত্র সংসদের সদস্যেরা মাত্রা ছাড়িয়ে যান। সুরোজদের দাবড়ানি অনেকক্ষণ সহ্য করলেও শেষে ধৈর্য হারিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিরঞ্জনবাবুকে বলতে শোনা যায়, “আমি যখন অপদার্থ, তখন তুই এই চেয়ারে বসে পড়!”
পুলিশ চলে আসার পরে সুরোজরা চলেও গেলেও কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ ঘিরে ধরেন অধ্যক্ষকে। তাঁদের দাবি, ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে ঢুকেছিলেন। তখন কলেজের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে জন্য বেশ কয়েক জন শিক্ষক অধ্যক্ষের ঘরে ছিলেন। আরও কয়েক জন ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁদের সরিয়ে সুরোজ ও তাঁর দলবল গায়ের জোরে ঘরে ঢুকে অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত থাকা শিক্ষকদের বাইরে বের করে দেন। শিক্ষকদের বক্তব্য, “এই রকম পরিবেশে কলেজে পড়ানোর কাজ করা যায় না।”
এ দিনই মহকুমাশাসকের (বর্ধমান উত্তর) অফিসে গিয়ে তাঁকে সমস্ত ঘটনা জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মহকুমাশাসক পুষ্পেন সরকার বলেন, ‘‘অধ্যক্ষ-সহ শিক্ষক-শিক্ষিকারা এসে কিছু অভিযোগ জানিয়েছেন। আমি জেলাশাসককে রিপোর্ট করব।’’ পদাধিকার বলে জেলাশাসকই হলেন রাজ কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি।
সুরজদের আচরণকে সমর্থন করছে না জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদও। সংগঠনের জেলা সভাপতি বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সংগঠনের নাম করে কয়েক জন কিছু শিক্ষককে বাঁচাতে পথে নেমেছে।” আর নিরঞ্জনবাবু বলেন, “কারা করছে, কেন করছে—সেটা সকলের কাছে স্পষ্ট। পুত্রসম ছাত্ররা যতই আঘাত করুক, রাজ কলেজকে পুরনো অবস্থায় ফিরতে দেব না।”