সলতে পাকানোর কাজটা হয়ে গিয়েছিল আগের দিনই।
বর্ধমানের পূর্বস্থলী কলেজে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমা নিয়ে যে ধুন্ধুমার হবে, তা টের পাওয়া গিয়েছিল আগের দিন বিকেলেই। সেই কুরুক্ষেত্রে এক পক্ষের ভরসা সজল ঘোষ, অন্য পক্ষে ছাত্রনেতা লোকনাথ দেবনাথ। ছাত্র সংসদ দখল করতে পারলে যার সাধারণ সম্পাদক হওয়া প্রায় বাঁধা ছিল বলে কলেজের অনেকেরই ধারণা।
এসএফআই বনাম টিএমসিপি এই পাঞ্জায় রাজ্যের শাসকদল কিছুটা পিছিয়েই ছিল। সৌজন্যে, কুলকামিনী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা পূর্বস্থলীর দাপুটে সিপিএম নেতা প্রদীপ সাহার একচ্ছত্র প্রভাব। এই অবস্থায় তৃণমূলের তরফে দলের ছাত্র সংগঠন মজবুত করার ভার দেওয়া হয়েছিল সুসংগঠক বলে পরিচিত যুবনেতা সজল ঘোষকে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কলেজে টিএমসিপির সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু পর্দার পিছনে যে উত্তেজনা ধোঁয়াচ্ছে তা টের পাওয়া গিয়েছিল মনোনয়ন জমার আগের দিন, ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি বিকেলেই। বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা সজল ঘোষ হত্যা মামলায় অন্যতম ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ ফজলুল হক মণ্ডলের দাবি, সে দিন টিএমসিপি-র ছেলেরা স্থানীয় কালেখাঁতলায় প্রচার করতে গেলে লোকনাথের নেতৃত্বে এসএফআই তাঁদের আটকে রাখে। সজল তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন। পুলিশে বিষয়টি জানানো হলেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে তাঁর অভিযোগ।
ওই সময়ে পূর্বস্থলী পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন তৃণমূলের কাজল শেখ। সমবয়সী না হলেও তাঁকে আর দলের পূর্বস্থলী অঞ্চল সহ-সভাপতি সজলকে লোকে অভিন্নহৃদয় বন্ধু বলেই জানত। মামলার অন্যতম ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ কাজলের দাবি, “সে দিন রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ আমরা রোজকার মতো পার্টি অফিসে বসে ছিলাম। কাজলের মোবাইলে একটা ফোন আসে। বেশ চড়া সুরে কথা বলতে-বলতে ও একটু দূরে চলে যায়। বোঝা যাচ্ছিল, কারও সঙ্গে চ্যালেঞ্জের সুরে কথা বলছে। ফোন শেষে করে ফিরে উত্তেজিত ভাবে ও বলে, ‘লোকনাথ আমায় গরম দেখাচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে দেখে নেবে বলে!’ সে রাতে এই নিয়ে কথা বাড়াইনি।”
সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল সম্পাদক সুব্রত ভাওয়াল অবশ্য গোটা বিষয়টিকেই ‘মিথ্যা গল্প’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। পরের দিন, ৯ জানুয়ারি কলেজে মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে দু’পক্ষের মারপিট হয়। টিএমসিপি-র দু’জন ও এসএফআইয়ের এক ছাত্র আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিন সন্ধ্যাতেও কাজল এবং সজল দীর্ঘক্ষণ এক সঙ্গে স্থানীয় চুপি গ্রামে অকিঞ্চন অক্ষয় দত্ত গ্রন্থাগারে ছিলেন। কাজলের জবানিতে: “আর ক’দিন পরেই ছিল ওই গ্রন্থাগারের পরিচালন সমিতির ভোট। সাড়ে ৭টা পর্যন্ত প্রচারের কাজ সেরে সজল বাড়ি ফেরে। তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে যখন পার্টি অফিসে যাই, তখন ঠিক হয় নবদ্বীপে আমাদের আহত ছাত্রদের দেখতে যাব।”
পূর্বস্থলী উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেই সে রাতে কয়েক জন নবদ্বীপ হাসপাতালে যান। কাজল বলে চলেন “আমার যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সজল কিছুতেই ছাড়ল না। অন্য এক জনকে বিধায়কের গাড়ি থেকে নামিয়ে আমায় ঠেলে তুলে নিজে উঠল।” বলতে-বলতে চুপ করে যান কাজল। চোখ ভিজে আসে। ধরা গলায় বলেন, “ও আমায় সঙ্গে নিয়ে গেল, কিন্তু আমি ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।”
তৃণমূলের অভিযোগ, রাত ১১টা নাগাদ লোকনাথ হাসপাতালে এসে এক জনকে দিয়ে টিএমসিপি-র আহত ছাত্র শৌভিক আইচকে ওয়ার্ড থেকে ডেকে পাঠায়। সজল তখন ওয়ার্ডেই ছিলেন। তিনিও নেমে ইমার্জেন্সি গেট দিয়ে বাইরে বেরোতেই প্রদীপ সাহা ছুটে এসে সজলকে জাপটে ধরেন, লোকনাথ বুকে রিভলভার ঠেকিয়ে তাঁকে গুলি করে। প্রদীপবাবু-সহ পাঁচ অভিযুক্ত গত সপ্তাহেই প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাসিন্দা লোকনাথকে (ত্রিপুরায় তার আত্মীয়ের বাড়ি) পুলিশ ধরতে পারেনি।
চোখ মুছতে-মুছতেই কাজল বিড়বিড় করেন, “যে খুন করল তার সাজা হওয়া দূরে থাক, অপদার্থ পুলিশ ধরতে পর্যন্ত পারল না! যারা ধরা পড়ল, তারা বেকসুর খালাস। কি জানি, আমরা হয়তো আদালতকে ঠিক মতো বোঝাতে পারিনি! সজল খুনের কোনও বিহিত হল না, এই আক্ষেপ আমার কোনও দিন যাবে না!”