নাবিধসার প্রকোপে ফলন কমছে আলু চাষে। গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও কালনার বহু জায়গায় এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। চাষিদের দাবি, কীটনাশক ব্যবহার করলেও ফল মিলছে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, কীটনাশক নিয়ম না মেনে ব্যবহার করাতেই এই বিপত্তি।
এ জেলায় আলু চাষে নাবিধসা রোগ অবশ্য নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০০৮ সালে জেলায় সব থেকে বেশি নাবিধসা দেখা গিয়েছিল। সে বছর নাবিধসা রোগের সঙ্গে আলু গাছের কাণ্ড পচা রোগও দেখা গিয়েছিল। এ বারও সেই একই সমস্যা হচ্ছে বলে চাষিদের দাবি। ফলে মহকুমায় আলুর ফলনও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই কম এ বার। এলাকার চাষিদের ক্ষোভ, রাসায়নিক সার ব্যবহার ও জমি তৈরি-সহ বিভিন্ন খাতে চাষের খরচ বেড়েই চলেছে। এর উপর নাবিধসা রোগে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাঁরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কীটনাশক প্রয়োগ করেও লাভ হচ্ছে না। সম্প্রতি কালনায় একটি অনুষ্ঠানে রাজ্যপালের সামনেই এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চাষিরা।
কিন্তু প্রায় প্রতি বছরই কেন এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে? কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মূলত আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার কারণেই এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ হঠাত্ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, মেঘলা পরিবেশ, ঝিরঝিরে বৃষ্টিএ রকম পরিস্থিতিতে নাবিধসা রোগ বেশি দেখা যায়। এ বছর আলু চাষ শুরুর সময় এক রকম আবহাওয়া থাকলেও পরে সেটা বদলে গিয়েছে। তবে জেলার কৃষি কর্তারা জানালেন, নাবিধসা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে গাছের সবুজ পাতায় পোড়া দাগ দেখা দেয়। তাঁদের মতে, খামখেয়ালি আবহাওয়া ছাড়াও অত্যধিক সার প্রয়োগের ফলেও আলু চাষে রোগের প্রকোপ ঘটছে। এ ছাড়াও একই জমিতে একাধিক ফসলের চাষ জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। ফলে জমিতে সহজেই ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে।
সম্প্রতি কালনা ১ ব্লকের অর্ন্তগত সুলতানপুর পঞ্চায়েতের দু’টি গ্রামে নাবিধসা আক্রান্ত জমি পরিদর্শন করেন রাজ্যের উপ-কৃষি অধিকর্তা দক্ষিণারঞ্জন বৈদ্য, অণুজীববিদ উত্তম রায়চৌধুরী, কীটতত্ত্ববিদ বিজয় চৌধুরি-সহ এক দল পরিদর্শক। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা জানান, চাষের পদ্ধতিতেই গলদ রয়েছে। তাঁদের দাবি, এ বার ওই দুই গ্রামে কেউ প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন, আবার কেউ ভুল কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। তাই টাকা খরচ করেও আলু গাছ বাঁচানো যায়নি। দক্ষিণারঞ্জনবাবু বলেন, “মূলত মেঘলা আবহাওয়ার কারণেই নাবিধসা রোগ ছড়ায়। গত বছর ডিসেম্বরে কয়েক দিন আকাশ মেঘলা ছিল। তাই এ বার কিছু জমিতে নাবিধসা দেখা দিয়েছে।”
অণুজীববিদ উত্তমবাবুর দাবি, চাষের শুরুতে চাষিরা যদি কীটনাশক প্রয়োগ নিয়ে সচেতন হতেন তাহলে নাবিধসা ছড়িয়ে পড়ত না। তিনি জানান, এলাকায় ভাল আলু বীজ না মেলায় জেলার অধিকাংশ চাষি পঞ্জাবের বীজের উপর নির্ভরশীল। সেই বীজ কিনতে হয় খোলাবাজার থেকে। চড়া দাম দিয়ে কেনা সেই বীজ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অশোধিত অবস্থায় থাকে। সেগুলি জমিতে লাগানোর আগে ঠিকমতো শোধন করা হয় না। ফলে নাবিধসার সম্ভাবনা আরও বাড়ে।
কালনা মহকুমার সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষের পরামর্শ, নাবিধসা থেকে বাঁচতে গোড়াতেই সাবধান হতে হবে। চাষিদের শোধিত বীজ ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া নাবিধসার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেই ব্লক অথবা মহকুমার কৃষি দফতরে দেখা করা এবং সঠিক পদ্ধতিতে কীটনাশক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। জেলার সহ-কৃষি অধিকর্তা (শস্য সুরক্ষা) সুপ্রিয় ঘটকের আক্ষেপ, “প্রতি বছর আলু চাষের আগে চাষিদের মধ্যে লিফলেট বিলি করা হয়। সঠিক আলু চাষের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা সভা করা হয়। কিন্তু তারপরেও অনেকেই তা করেন না। তাই সমস্যা তৈরি হয়।” তাঁর আশ্বাস, সামনের বছর নাবিধসা আটকাতে কৃষি দফতর আরও আগে থেকে প্রচার শুরু করবে।