চিকিৎসক হতে চায় শুধু সাগির, বাকিদের ঝোঁক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে

সকাল থেকেই বুকের ধুকপুকানিটা খানিকটা বেড়েই ছিল সৌরভের। একবার জানালার পাশে, একবার বিছানায়, কিছুতেই স্থির হতে পারছিল না। তার মধ্যেই এক বন্ধুর ফোন- তোর রেজাল্ট শুনেছিস। এরপরেই বাড়ির সামনে ভিড় জমতে থাকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি সকলের।

Advertisement

রানা সেনগুপ্ত ও সৌমেন দত্ত

বর্ধমান ও কাটোয়া শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০১:৩৮
Share:

বাঁ দিক থেকে, পড়শিদের কাঁধে সৌরভ। মায়ের সঙ্গে পরমেশ। মায়ের সঙ্গে সৌরভ। স্কুলে সাগির। নিজস্ব চিত্র।

সকাল থেকেই বুকের ধুকপুকানিটা খানিকটা বেড়েই ছিল সৌরভের। একবার জানালার পাশে, একবার বিছানায়, কিছুতেই স্থির হতে পারছিল না। তার মধ্যেই এক বন্ধুর ফোন- তোর রেজাল্ট শুনেছিস। এরপরেই বাড়ির সামনে ভিড় জমতে থাকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি সকলের। চলে আসেন কাটোয়ায় শহরের ভারতী ভবন স্কুলের প্রধান শিক্ষক-সহ অন্যরা। হাজার হোক ওই স্কুল থেকেই তো এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৭৫ পেয়ে রাজ্যে দ্বিতীয় হয়েছে কাটোয়ার বিজয়নগরের সৌরভ পাল।

Advertisement

ছেলের ফল শুনে বিভাষবাবু বলেন, “আমাদের একটা রেডিও আছে। টিভি কিনতে পারিনি। এর বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়েও বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে সংবাদমাধ্যমের লোক দেখে বিশ্বাস হয়।” চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে তার। দু’বিঘা জমির ভরসাতেই বছরভর সংসার চলে সৌরভদের। সৌরভ অবশ্য কাটোয়া স্টেডিয়ামের কাছে মামারবাড়ি থেকেই উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনা করত। মা সীমাদেবী বলেন, “দু’বছর ছেলে খেলাধুলো করেনি। দু’এক দিনের জন্য বাড়ি এলেও বই নিয়েই পড়ে থাকত।” তাছাড়া কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও আর্থিক সাহায্য দিত তাকে। স্কুলের তরফ থেকেও বেশ কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। প্রিয় বিষয় অঙ্ক আর রসায়নে ১০০ই পেয়েছে সৌরভ। ১০০ পেয়েছে বায়োলজিতেও। আর বাংলা, ইংরাজি ও পদার্থবিদ্যায় যথাক্রমে পেয়েছে ৯০, ৮৫ ও ৯৯। এ দিন সৌরভ বলে, “৪৫৫ আশা করেছিলাম। আরও ২০ নম্বর বেশি পাব ভাবিনি।”

ভারতী ভবনের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “সৌরভ দেখিয়ে দিল মেধাকে কখনও আটকানো যায় না।” সৌরভের চিন্তা অবশ্য একটাই ভাল কলেজে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পাব তো?

Advertisement

বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলেরই সৌরভ চক্রবর্তী ৪৭১ পেয়ে রাজ্যের মধ্যে সম্ভাব্য ষষ্ঠ। সে মাধ্যমিকে পেয়েছিল ৬৬২। তার মেধাতালিকায় ১৩ নম্বরে নাম ছিল । এবার ৪৭১ পেয়ে খুশি হলেও আরও বেশি নম্বর আশা করেছিল, জানিয়েছে সৌরভ। তার বিভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর বাংলায় ৮৫, ইংরেজিতে ৯১, রসায়ণ ৯৭, গণিত ৯৯, পদার্থবিদ্যায় ৯৯ ও পরিবেশ বিজ্ঞানে ৯৭।

ওই স্কুলেরই আরেক ছাত্র সৌরভ চক্রবর্তী ৪৭১ পেয়ে রাজ্যের মধ্যে সম্ভাব্য ষষ্ঠ। তবে আরও একটু বেশি নম্বর আশা করেছিল সে। বাংলায় ৮৫, ইংরেজিতে ৯১, রসায়নে ৯৭, গণিতে ৯৯, পদার্থবিদ্যায় ৯৯ ও পরিবেশ বিজ্ঞানে ৯৭ পেয়েছে সে। সৌরভের বাবা শান্তনুবাবু দীর্ঘদিন অসুস্থ। মা আরতিদেবী অনাময় হাসপাতালের নার্সিং স্টাফ। ছেলের রেজাল্টের খবর শুনে আরতিদেবী বলেন, “লেখাপড়া নিয়ে ছেলেবেলা থেকেই যথেষ্ট মনোযোগী ও। সবসময় নিজের পড়া পড়েছে। খেলার সময় খেলেছে।” আর সৌরভ বলে, “আর একটু বেশি নম্বর পেতে পারতাম বাংলাতে। তাহলে হয়তো র্যাঙ্কটা একটু ওপরে থাকতো। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। আমি আর পরমেশ সেটাই করেছি।” সৌরভও ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়র হতে চায়।

স্কুলের দু’জন ছাত্র মেধাতালিকায় স্থান পাওয়ায় খুশি প্রধান শিক্ষক শম্ভুনাথ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “সব শিক্ষককে এর জন্য কৃতিত্ব দিতে চাই, তার সঙ্গে পরিচালন সমিতি ও অভিভাবকদেরও। স্কুল যে ভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে আমি গর্বিত।”

বর্ধমান সিএমএস স্কুলের শেখ মহম্মদ সাগিরও ৪৬৮ পেয়ে প্রকাশিত মেধাতালিকায় নবম স্থানে রয়েছে। মাধমিকেও নবম স্থানে ছিল সে। এ দিন সাগির বলে, “জায়গাটা ধরে রাখতে পারব কী না, তা নিয়ে চাপে ছিলাম। মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করলে তো প্রতাশা বাড়ে সকলের। যাই হোক, আজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারব।” সাগিরের দিদি বলে, “ভাই যে রকম পরিশ্রম করেছে, তাতে ও যে একটা স্থান পাবেই তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম। ভাই আমাদের মুখ রেখেছে।”

এ বছর সাগির বাংলায় ৯০, ইংরেজিতে ৯৪, পদার্থবিদ্যায় ৯৬, রসায়নে ৯৪, জীববিদ্যায় ৯৪ পেয়েছে। তার বাবা রফিক শেখ ইংরেজি শিক্ষক। ছেলের রেজাল্ট শুনে গর্বিত গলায় বলেন, “ছেলে আমার চেয়েও ভাল ইংরেজি জানে।” আর মা রেহানা বিবি বলেন, “আমার বিশ্বাস ছেলে আরও ভাল রেজাল্ট করবে।” ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চায় সাগির। পাখির চোখ তাই জয়েন্ট। পদার্থবিদ্যায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য স্কুলের শিক্ষক গদাধর হাজরার প্রতি কৃতজ্ঞ সে। বলে, “স্যার এত ভাল শিখিয়েছেন যে কোনওদিন ভুলব না।” অবসর সময়ে ক্রিকেট খেলে, গল্পের বই পড়ে আর ফেসবুক করে সময় কাটে সাগিরের। প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, “২০০৭ সালে স্কুলের এক ছাত্র মহম্মদ আজাদ মেধাতালিকায় নাম তুলেছিল। তার প্রায় সাত বছর পরে এই সাফল্য আমরা গর্বিত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন