চলছে ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ। শহরের সুবোধ স্মৃতি রোডে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
জমির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহার্ঘ হয়ে উঠছে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও। তাই দু’মহলা, ঝুল বারান্দার বাড়ি নয় বরং ‘টু-বিএইচকে’র নিশ্চিন্ত আড়াল খুঁজছে কাটোয়া।
প্রতিদিন বাইরে থেকে আসা হাজারো মানুষের চাহিদা মেটাতে বাড়ি ভাড়া উর্ধ্বমুখী হয়েছে আগেই। এখন বাড়ি তৈরি মানেই একতলায় ভাড়া দেওয়ার বন্দোবস্তো থাকে। তবে তাতেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় টুকটুক করে বহুতলের দিকে ঝুঁকছে শহর। নির্মাতারাও মেনে নিয়েছেন, ফ্ল্যাট কালচার ঢুকে পড়ছে গ্রামীণ এ শহরে।
বাড়ি মালিকেরা জানিয়েছেন, এলাকা অনুযায়ী বাড়ি ভাড়ার তারতম্য রয়েছে। গত বছর কাটোয়া কলেজের পিছনের এলাকায় যেখানে বাড়ি ভাড়া ছিল ২৬০০ টাকা। নতুন বাসিন্দা আসতেই সে বাড়ির ভাড়া হয়ে গিয়েছে ৩৫০০ টাকা। সার্কাস ময়দান, টেলিফোন ময়দান এলাকাতেও বাড়ি ভাড়া পাঁচ হাজার টাকায় পৌঁছে গিয়েছে। কলেজ পাড়া এলাকার বাসিন্দা এক যুবকের কথায়, “স্কুল-কলেজ হাতের নাগালে হওয়ায় এলাকার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন লোক ভাড়া নেবে বলে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে। তা না হলে দোতলা একটি বাড়ির জন্য ৪৫ লক্ষ টাকা দাম চেয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন কেউ দেয়!” কাছারি রোডের একটি বহুতলের মালিক তথা শহরের নামী স্বর্ণ ব্যবসায়ীও বলেন, “বাড়ি ভাড়ার চাহিদা রয়েছে। তবে আমি ১১ মাসের চুক্তি করে ভাড়া দিই। আর শহরের বাসিন্দাদের ভাড়া দেব না বলেই ঠিক করে রেখেছি।” এ ধরণের বহুতলগুলির এক কামরার ফ্ল্যাটের ভাড়া ৩৫০০ টাকা, আর দু’কামরার ফ্ল্যাটের ভাড়া ৫০০০ টাকা।
কিন্তু কাটোয়ায় বাস করার এত ঝোঁক কেন?
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, কাটোয়া শহরে নিশ্চিন্তে বসবাস করে ন্যূনতম শিক্ষা-চিকিত্সা পাওয়া যায়। গ্রামে থেকে যা পাওয়া সম্ভব নয়। নদিয়ার একটি স্কুলের শিক্ষক রামরতন দাস বলেন, “গ্রামীণ পরিবেশ হওয়ায় কাটোয়াতে এখনও দৈনন্দিন খরচ অন্যান্য শহরের তুলনায় কম। দাম অনুযায়ী সব্জি বা মাছের গুণগত মানও বেশ ভাল। এ সব ভেবেই কাটোয়া শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছি।” অনেকে আবার দু-তিন বছর ভাড়া থাকার পরে শহরের ভিতর জমি কিনে বাড়ি করে নিচ্ছেন। কাটোয়ার সহকারী স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) বিপদভঞ্জন মণ্ডল জানান, কাটোয়া মহকুমায় ১২৩ টি স্কুল রয়েছে। তাছাড়া শহর ঘেঁষা পাশের জেলাগুলিতেও অন্তত ৫০টি স্কুল রয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের দৌলতে এই ১৭৩টি স্কুলে বাইরে থেকে প্রচুর নতুন শিক্ষক যোগ দিয়েছেন। তাঁদের একটা বড় অংশ কাটোয়া শহরে বাস করেন। তাঁরাই মূলত ভাড়া নিয়ে থাকছেন।
এই ক’বছরে শহরে বেশ কিছু সরকারি, বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখা খুলেছে। শিক্ষকদের পাশাপাশি ওই সব ব্যাঙ্কের কর্মীরাও ভাড়া নিয়ে কাটোয়া শহরে থাকছেন। বীরভূমের নানুর থানা এলাকার বাসিন্দা সুমন দাস বলেন, “আমাদের এলাকার অনেকেই রুজি রোজগারের জন্য প্রতিদিন কাটোয়াতে যাতায়াত করতেন। গত কয়েক বছর ধরে টালমাটাল অবস্থার জন্য আমাদের মতো অনেকেই কাটোয়া শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন।” কলেজপাড়ার বধূ বেলি সিংহের মতে, “এখনও পর্যন্ত এ শহরে তেমন রাজনৈতিক উপদ্রব নেই। নিরাপত্তাও রয়েছে। ফলে রাতবিরেতে একা রাস্তায় বের হওয়া যায়।” তাঁর দাবি, “সবদিক দিয়ে বসবাসের উপযুক্ত হওয়ায় কাটোয়ার দিকে মানুষের ঝোঁক বাড়ছে।”
বেলিদেবীর কথার সুর ধরে শহরের এক প্রোমোটারও বলেন, “সুবোধ স্মৃতি রোডে পরীক্ষামূলক ভাবে বহুতল গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। নিমেষের মধ্যে সেই বহুতলের সব ঘর বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ওই বহুতল নির্মাতা পাশেই ফের বহুতল গড়ছেন। সেখানেও আর ঘর খালি নেই বললেই চলে।” এ হেন পরিস্থিতিতে কাটোয়ার দিকে নজর পড়েছে রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলিরও। ওই সব সংস্থার কর্তারা নিয়মিত ভাবে এসটিকেকে কিংবা বর্ধমান-কাটোয়া রোডের ধারে জমি দেখছেন। শহরের ভিতর দু’একটি জায়গাতেও কয়েক মাসের মধ্যে কিছু রিয়েল এস্টেট সংস্থা বহুতল গড়ার কাজে হাত দিতে চলেছে বলে জমির মালিকেরা জানিয়েছেন।
রাজ্যের আবাসন দফতরের প্রাক্তন আধিকারিক, বর্তমানে এক রিয়েল এস্টেট সংস্থার কর্তা বলেন, “আমি সরকারি কাজে বেশ কিছু দিন কাটোয়াতে ছিলাম। শহরের পুরনো এলাকায় বাড়ি তৈরির সম্ভাবনা আর নেই। তবে সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় বহুতলের দিকে ঝোঁক দিচ্ছে। আবার গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারাও শহরের সুযোগ সুবিধা চেয়ে বহুতল খুঁজছেন।” কাটোয়ার প্রাক্তন এক বিডিওর কথায়, “শহর ও শহরতলির বাসিন্দারা নিয়মিত নানা কাজে কলকাতা ছুটছেন। ফলে তাঁদের মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে। সেই থেকেই বহুতলের চাহিদাও তৈরি হয়েছে।” শহরের অনেকেই মনে করছেন, কাটোয়াতে এনটিপিসি বিদ্যুত্ প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিলে বহুতল গড়ার প্রক্রিয়াটা আরও দ্রুত শুরু হয়ে যাবে। বিদ্যুত্ প্রকল্প গড়ে ওঠার পাশাপাশি আরও শিল্পপতিরা এলাকায় বিনিয়োগ করবে। জনবসতি বাড়লে আবাসন-শিল্পও বেড়ে উঠবে। আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত এক কর্তার ব্যাখ্যা, “সাধারণ বাড়ির চেয়ে নিরাপত্তার কারণেও অনেকে বহুতলে থাকতে পছন্দ করেন। আবার অনেকে বাড়ি তৈরির করার ঝামেলা এড়াতেও মফস্সল শহরে ফ্ল্যাট কিনছেন।”
তবে বিপরীত একটা ভাবনাও রয়েছে। অনেকেরই মতো, বেশি বহুতল গড়ে উঠলে কংক্রিটের জালে মুখ ঢাকবে শহর। কমবে সবুজ।
কাটোয়ার প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা বর্তমান বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “পাঁচতলার বেশি বাড়ি তৈরির অনুমোদন পুরসভা দেয় না। কিন্তু নগরায়নের জন্য যে নিয়ম আসতে চলেছে তাতে আমদের মতো ছোট শহরেও বহুতল গড়ার প্রবণতা হু হু করে বাড়বে। আমরা চাই না কাটোয়াতে কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে উঠুক।”
ফলে চেনা উঠোন, তুলসিতলার মায়া কাটিয়ে ভবিষ্যত্ কাটোয়া যে বহুতলে বাঁধা পড়ছে তা একপ্রকার নিশ্চিত।