পড়েছে কেবল কয়েকটি ফ্লেক্স। আবাসন এলাকায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
খুলব খুলব করেও শেষমেশ আর খোলেনি। ও দিকে এক হাজারেরও বেশি আবাসনের দরজা, জানলা, লোহার গ্রিল সব খুলে নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। মাটি খুঁড়ে জলের পাইপ থেকে শুরু করে নদর্মার উপরে কংক্রিটের চাদর ভেঙে লোহার রড, তাদের হাত থেকে বাদ যায়নি কিছুই।
ঝোপজঙ্গলে ভরা আবাসনে নিতান্তই নিরুপায় হয়ে রয়ে গিয়েছেন কারখানার স্বেচ্ছাবসর নেওয়া শ’দেড়েক কর্মী। চার বড় দলের কোনও প্রার্থী প্রচার করতে তাঁদের কলোনিতে ঢোকেননি। তবু ভোট দিতে যাবেন, জানাচ্ছেন তাঁরা। অনেকেই বলছেন, “আমরা কী ভাবে বেঁচে আছি, তা দেখতে কেউ আসেনি। তবে এ বার ভোট দিতে গিয়ে কোনও প্রার্থীকে পছন্দ না হলে ‘না ভোট’-এর সুযোগ তো রয়েছেই!”
কেন্দ্রীয় সরকারের পেট্রোলিয়াম ও সার মন্ত্রকের অধীনস্থ দুর্গাপুরের ‘হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন লিমিটেড’ (এইচএফসিএল) গড়া শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী কারখানার শিলান্যাস করেন। ইতালির প্রযুক্তিতে প্রায় ছ’শো একর এলাকায় কারখানা গড়ে ওঠে। চারশো একর জায়গায় হাজার আবাসনের কলোনি, স্কুল, হাসপাতাল, প্রেক্ষাগৃহ, বাজার, খেলার মাঠ তৈরি ওঠে। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৩ সালে। চাকরি হয় প্রায় তেরোশো কর্মীর। রাজ্যের একমাত্র সার কারখানায় ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু হয় পরের বছর থেকে। নয়ের দশকের গোড়া থেকে কারখানা রুগ্ণ হতে শুরু করে। এখানে সার তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ন্যাপথা ব্যবহার করা হত। ন্যাপথা ব্যবহার করে ইউরিয়া উৎপাদনের খরচ বেশি পড়ায় বিদেশ থেকে কম দামে ইউরিয়া আমদানি শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৯৮ সালে উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কারখানা চলে যায় বিআইএফআর-এর অধীনে।
২০০৩ সালে ১১২৫ জন শ্রমিক-কর্মী স্বেচ্ছাবসর নেন। পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় কারখানা। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল, হাসপাতাল। আবাসন ছেড়ে চলে যান শ্রমিক-কর্মীরা। উপায় না থাকায় থেকে যায় প্রায় দু’শো পরিবার। পরে যদিও কয়েকটি পরিবার চলে যায়। এখন প্রায় ১৮০টি পরিবার বাস করে। বাকি আবাসনগুলি ফাঁকা পড়ে আছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, সমাজবিরোধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে পুরো কলোনি। পরে মিথেন গ্যাস ব্যবহার করে সরকারি পর্যায়ে কারখানা খোলার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনও স্থির সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০০৮ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা কারখানা খোলার আগ্রহ দেখায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সায় না দেওয়ায় পরে তারা পানাগড়ে নিজস্ব কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এইচএফসিএলের আবাসনে যে সমস্ত প্রাক্তন কর্মী এখনও রয়েছেন, তাঁদের মোটা টাকা গচ্ছিত রাখা আছে সংস্থার কাছে। এর বাইরে তাঁরা মাসিক ভাড়া, জল, বিদ্যুৎ-সহ অন্য খরচও দেন। আগে আট মাসের লিজে তাঁদের থাকার অনুমতি দেওয়া হত। জানুয়ারিতে শেষ বার যে নতুন চুক্তি হয়েছে তাতে মেয়াদ বেড়ে হয়েছে ১১ মাস। এ ভাবেই ২০০৩ সাল থেকে এইচএফসিএল কলোনিতে রয়েছেন প্রাক্তন কর্মী আশিস মুখোপাধ্যায়, বলরাম সাহু, বাদল মুখোপাধ্যায়, অনাদি মিশ্র, গৌরসিংহ সর্দার, বলদেব মণ্ডলেরা। রোজ বিকেলে তাঁরা তৎকালীন মনিমালা মাঠে তাস খেলতে বসেন, স্মৃতিচারণায় মেতে ওঠেন। তাঁরা জানান, এই কলোনির স্কুল, হাসপাতালের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশে। খেলা, সংস্কৃতি সব দিক থেকেই শহরকে তাক লাগিয়ে দিতেন তাঁরা। কিন্তু এখন ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবাটুকুও পান না বলে অভিযোগ।
কলোনির বাসিন্দারা জানান, লোহা চোরেরা দিনে-দুপুরে দাপিয়ে বেড়ায়। রাস্তার আলো এক বার নষ্ট হয়ে গেলে আর লাগানো হয় না। বড় বড় পুরনো গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। তাঁরা বলেন, “বিশাল কলোনিতে আমরা নিতান্তই সংখ্যালঘু। পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ড। কিন্তু পাশের বিধাননগর ফাঁড়ির পুলিশ ডাকলে আসে না। বলে এটি কাঁকসা থানা এলাকার মধ্যে। অথচ কাঁকসা থানা ২০ কিলোমিটার দূরে!” তাঁরা জানান, ঝোপজঙ্গলে ভরা কলোনিতে রাতে একলা মহিলারা চলতে ভয় পান। ফাঁকা আবাসনগুলিতে যদি সরকারি ভাবে ভাড়া নিয়ে মানুষজনের থাকার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সমস্যার অনেকটাই সুরাহা হয়। কিন্তু উদ্যোগী কে হবে? প্রশ্ন তাঁদের।
কলোনির বাসিন্দারা জানান, ভোটের প্রচার করতেও কোনও দলের প্রার্থী আসেননি। কলোনির বাইরের দিকের মোড়ে অবশ্য পথসভা করেছে একাধিক দল। “কলোনির ভিতরে দু’একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে একাধিক দল। তবে আমাদের খোঁজ কেউ নেননি। প্রার্থী তো দূর কথা, কেউ আমরা কী ভাবে বেঁচে আছি তা দেখতে কোনও দলের কর্মীরাও আসেননি।”অভিমান ঝড়ে পড়ে আশিসবাবু, বলরামবাবু, বাদলবাবুদের গলায়। হঠাৎ কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায় আশপাশ। কারখানার আর এক প্রাক্তন কর্মী তখনই বলে ওঠেন, “এ বার চিন্তা নেই। কিছু না হলে শেষ পর্যন্ত ‘নোটা’ বোতাম তো আছে!” হেসে ওঠেন বাকিরাও।