গণতন্ত্র নেই বাংলায়— প্রত্যেকটি বিরোধী দলের মুখে একই কথা। —পিটিআই থেকে নেওয়া ফাইল চিত্র।
হাতে আর মাত্র একটা দিন। টক্কর যদি সেয়ানে সেয়ানে দিতে হয়, তা হলে অন্তত হাজার পঁচিশেক গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে মনোনয়ন জমা দিতে হবে এই এক দিনেই। না হলে ভোটের অনেক আগেই পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে বিরোধীদের। বাংলার সবক’টি বিরোধী দলের নজর তাই আপাতত সুপ্রিম কোর্টের দিকে। রাজ্য বিজেপি অবশ্য বলছে, প্রার্থীরা কাগজপত্র নিয়ে তৈরি। শেষ দিনে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাবে দল।
রাজ্যে মোট জেলা পরিষদ আসন ৮২৫টি। শনিবার পর্যন্ত তৃণমূল প্রার্থী দিয়েছে ৭৩৭টি আসনে। দ্বিতীয় স্থানে বিজেপি— ৪৩২। বামফ্রন্ট প্রার্থী দিয়েছে ৩৬২টি আসনে। কংগ্রেস ১৩৬টি-তে।
পঞ্চায়েত সমিতি স্তরেও একই ছবি। মোট আসন ৯,২১৭টি। তৃণমূল প্রার্থী দিয়েছে ৭,০৫৩টি আসনে। বিজেপি ৩,৭৫৩টি-তে। বামেরা ২,৩৩৫টি আসনে। আর কংগ্রেস প্রার্থী দিতে পেরেছে ৫৫৪টি-তে।
গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসন ৪৮,৬৫০টি। তৃণমূল শনিবার পর্যন্ত ৪৩,৩৬৮টি আসনে মনোনয়ন দাখিল করতে পেরেছে। বিজেপি জমা দিয়েছে ২১,২৯৮টি আসনে। বামফ্রন্ট ১১,৭০০টি এবং কংগ্রেস ৩,৩৮৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।
জেলা পরিষদ
জেলা পরিষদ তৃণমূল বিজেপি বামফ্রন্ট কংগ্রেস
মোট- ৮২৫ ৭৩৭ ৪৩২ ৩৬২ ১৩৬
পঞ্চায়েত সমিতি
পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূল বিজেপি বামফ্রন্ট কংগ্রেস
মোট- ৯,২১৭ ৭,০৫৩ ৩,৭৫৩ ২,৩৩৫ ৫৫৪
গ্রাম পঞ্চায়েত
গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল বিজেপি বামফ্রন্ট কংগ্রেস
মোট- ৪৮,৬৫০ ৪৩,৩৬৮ ২১,২৯৮ ১১,৭০০ ৩,৩৮৫
সরল পাটিগণিত বলছে, মনোনয়ন জমা দেওয়ার বিচারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত তৃণমূলের চেয়ে তারা অনেকটা পিছিয়ে। ফারাক প্রায় ২২ হাজার আসনের। সোমবার তৃণমূল আরও কিছু আসনে প্রার্থী দেবে। কিন্তু জেলায় জেলায় যে ভাবে বাধা পাচ্ছে বিরোধীরা, তাতে সোমবার বিজেপি কতগুলি আসনে মনোনয়ন জমা দিতে পারবে, তা রাজ্য নেতৃত্বও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। ফলে পঞ্চায়েতি লড়াইয়ের প্রাথমিক পর্যায়েই অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে বিজেপি-সহ বিরোধী দলগুলি।
বিরোধী দলগুলির মনোনয়ন জমা দেওয়া আটকাতে যে পরিমাণ সন্ত্রাসের অভিযোগ এ বার উঠছে, তা বেনজির। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে রকম আঙুল উঠছে, তাও বিরল। কিন্তু বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্ব সে সবের মাঝেই বার বার হুঙ্কার শুনিয়েছে। সব বাধা অগ্রাহ্য করেই বিজেপি লড়াই দেবে বলে নেতারা বার বার আশ্বাস দিয়েছেন। এত চ্যালেঞ্জ ছোড়ার পরে যদি দেখা যায়, অর্ধেক আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি বিজেপি, তা হলে নেতৃত্বের অস্বস্তি বাড়তে বাধ্য।
শাসকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বিজেপি লড়াইটাকে পৌঁছে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ছবিটা বদলায়নি। ছবি: পিটিআই।
রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য এখনও আত্মবিশ্বাসী। রবিবার তিনি আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘শেষ দিনেই প্রার্থী দিয়ে দেব। সর্বত্রই আমাদের প্রার্থীরা তৈরি। কাগজপত্র তৈরি। বাধা দিচ্ছে বলে জমা দিতে পারছিলাম না। সোমবার জমা দেব।’’
কিন্তু শুধু সোমবার কত মনোনয়ন জমা দেবেন? তৃণমূলের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ২২ হাজারের ফারাক। সোমবার তৃণমূল আরও অনেক আসনে প্রার্থী দেবে। ফারাকটা তা হলে ২৫-৩০ হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। এক দিনে অত আসনে প্রার্থী দেওয়া যাবে? দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘‘কেন যাবে না? আমাদের সবই তো রেডি। বাধা দিয়েছে বলে জমা দিতে পারিনি। দেখুন না কী হয়। তৃণমূলও তো অনেক আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্ট কালকে রায় দেবে। ইতিবাচক নির্দেশই হবে আশা করছি। নির্বাচন কমিশন তার পরে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য বাড়তি সময় দিতে পারেন। সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সব দেখতে পাবেন।’’
আরও পড়ুন: বাঁকুড়ায় ‘জয় শ্রীরাম’ বলে সিপিএমের মিছিলে ঝাঁপাল তৃণমূল
৩২০টি ব্লক অফিসের পাশাপাশি এসডিও অফিসগুলিতেও মনোনয়ন জমা নেওয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ব্লক অফিস ঘিরে রেখে যে ভাবে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতেই এসডিও অফিসেও মনোনয়ন জমা নেওয়ার নির্দেশ জারি করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। দিলীপ ঘোষ বলছেন, ‘‘এতগুলো ব্লক অফিস আর এসডিও অফিসে ভাগাভাগি করে তো মনোনয়ন জমা পড়বে। তা হলে এক দিনে ২৫ হাজার মনোনয়ন জমা দেওয়া আর কী এমন ব্যাপার।’’
দিলীপ ঘোষ যে কর্মীদের মনোবল ধরে রাখতেই আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছেন, তা নিয়ে সংশয় নেই। কারণ কমিশন যে নির্দেশই দিক, বিরোধীদের বাধা দেওয়ার ছবিটা একই রকম। এসডিও অফিসগুলোতেও অবরোধ তৈরি করছে তৃণমূল। দিলীপ ঘোষরা সে কথা জানেনও। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সোমবার সুপ্রিম কোর্টের রায় আসা পর্যন্ত কর্মীদের মনোবল যাতে বহাল থাকে, দিলীপবাবুরা সে চেষ্টাই চালাচ্ছেন।
মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে জেলায় জেলায় এ ভাবেই আক্রান্ত হচ্ছেন বিরোধীরা। ছবি: পিটিআই।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র সুরটা কিন্তু অন্য রকম। এতগুলো আসনে যদি মনোনয়ন জমা দিতে না পারেন, তা হলে ভোটের আগেই কি হেরে বসে থাকবেন না? এ প্রশ্নের জবাবে বাবুল বললেন, ‘‘তৃণমূলের ৪৩ হাজার, বিজেপি-র ২১ হাজার— এগুলো শুধুমাত্র কয়েকটা সংখ্যা, এগুলো কোনও হিসেব নয়। আজকের পরিস্থিতিতে এ সব সংখ্যার দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝা যাবে না। কারণ গণতন্ত্রটাকেই মেরে ফেলা হচ্ছে বাংলায়। অবাধ ভোট হতে দেওয়া তো দূরের কথা, বিরোধীদের ভোটে দাঁড়াতেই দেওয়া হবে না— শাসক দলের নীতিটা যেখানে এই রকম, পুলিশ-প্রশাসন যেখানে নির্লজ্জের মতো আচরণ করছে, নির্বাচন কমিশনে যেখানে কিছুই করতে পারছে না, সেখানে এই সব সংখ্যার দিকে তাকিয়ে কী হবে?’’
সুপ্রিম কোর্টের রায় কী হবে, মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় বাড়বে কি না, আর কত আসনে বিজেপি মনোনয়ন জমা দেবে, সে সব নিয়ে ভাবতেই চাইছেন না কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁর লক্ষ্য আপাতত ‘তৃণমূলের সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে লড়া।
আরও পড়ুন: ফের মারমুখী শাসক দল, নিস্পৃহ পুলিশ, অসহায় অধীর
বাবুল বললেন, ‘‘এখন দেখছেন ২১ হাজার আসনে আমাদের প্রার্থী রয়েছে। সোমবার হয়ত আরও কিছু আসনে প্রার্থী দিলাম। তার পরে তো তৃণমূল নতুন খেলা শুরু করবে। যাঁরা মনোনয়ন জমা দিলেন, এ বার মেরেধরে, ভয় দেখিয়ে তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে। এটা কি ভোট হচ্ছে!’’
প্রতিকার তা হলে কীসে? বাবুল বললেন, ‘‘আমি পরশু আসানসোল যাচ্ছি। টানা চার দিন ওখানে থাকব। ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানোর চেষ্টা ওরা করবেই। সেটা আটকাতে হবে। কর্মীদের পাশে দাঁড়াতেই ওখানে যাচ্ছি।’’
রাজ্য স্তরের আরও বেশি কিছু নেতাকে জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। ‘সন্ত্রাস’ সত্ত্বেও যে সব জায়গায় মনোনয়ন জমা দেওয়া গেল, সে সব জায়গায় লড়াইটা যাতে ভোট পর্যন্ত বহাল রাখা যায়, তা নিশ্চিত করাই আপাতত মাছের চোখ বিজেপি নেতৃত্বের কাছে।