অনন্যা লজ ঘিরে ফেলেছে বিরাট কেন্দ্রীয় বাহিনী। শ’খানেক সিআরপিএফ জওয়ান। লজের সমস্ত বুকিং বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সব ঘর বুকড্ কোনও এক ‘ভিভিআইপি’ অতিথি আর তাঁর পরিবারের জন্য।
এটা ২০১৬ সালের ছবি। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ছবিটা কেমন?
সেই ‘ভিভিআইপি’র বাড়ির রাস্তাটা চিনিয়ে নিয়ে গেলেন যে ব্যক্তি, তিনি বাইক থেকে নেমে হেলমেটটা খুললেন না। মুখ-মাথা ঢাকা অবস্থাতেই বড় লোহার গেটে দমাদ্দম চারটে ঘা দিলেন। ‘সুশান্তদা, ও সুশান্তদা’— ঠিক দু’বার ডাকলেন। ফের বাইকে চড়ে দ্রুত এলাকা ছাড়লেন।
‘সুশান্তদা’ অর্থাৎ সুশান্ত সরকার হলেন নবকুমার সরকারের ভাই। হুগলি জেলার গোঘাট ব্লক। বাঁকুড়া লাগোয়া। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং হিংসার জন্য বার বারই শিরোনামে এসেছে গোটা এলাকা। সেখানেই কামারপুকুর গ্রামে বাড়ি নবকুমার সরকারের। এই নামে অবশ্য এখন আর কেউ চেনেন না তাঁকে। নবকুমারকে প্রত্যেকেই চেনেন, তবে অন্য নামে। সেই নামটা হল স্বামী অসীমানন্দ। হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার হয়েছিলেন যে অসীমানন্দ। বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছেন। সম্প্রতি আদালত জানিয়েছে, অসীমানন্দ অপরাধী নন।
নাশকতার মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েই কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন অসীমানন্দ। রাজ্যে গেরুয়া হাওয়া আরও তীব্র করতে অসীমানন্দকে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব। খবর তেমনই। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি প্রচারে আসছেন, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ সরাসরি সে রকম কোনও কথা উচ্চারণ করলেন না। তবে এ কথায়-সে কথায় ইঙ্গিতটা তেমনই দিলেন। বেশ কিছু কথার পরে দিলীপ ঘোষ মেনে নিলেন, অসীমানন্দকে এ রাজ্যে প্রচারে আসতে বলা হয়েছে এবং তিনি নিজেই আসতে বলেছেন।
সুশান্ত সরকার অসীমানন্দেরই ভাই। ফলে তাঁর পরিবারকে যে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। বাম জমানায় বামেদের শাসানি ছিল, চলতি জমানায় তৃণমূলের রক্তচক্ষু রয়েছে সরকার পরিবারের উপরে। মিডিয়াকে ওই পরিবারের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতেও তাই স্থানীয় লোকজন অস্বস্তি বোধ করেন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে অবশ্য এখন আর কোনও উত্তাপ নেই এলাকাটায়। গোটা আরামবাগ মহকুমা বা পার্শ্ববর্তী জেলা বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মহকুমায় বিরোধী দলগুলির চিহ্নমাত্র নেই। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের অধিকাংশ আসনে মনোনয়নই জমা দিতে পারেননি বিরোধীরা। যে সব এলাকায় পেরেছিলেন, সেখানে প্রত্যাহার করানো হয়েছে। কামারপুকুরও এর ব্যতিক্রম নয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গ্রামের দখল চলে গিয়েছে তৃণমূলের হাতে। ভোট নেই, অতএব দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন, পোস্টারের দেখা নেই। ইতিউতি শুধু জোড়াফুল আঁকা পতাকা উড়ছে। আপাতদৃষ্টিতে অখণ্ড শান্তির রাজত্ব। কিন্তু অসীমানন্দের বাড়িতে পৌঁছে তাঁর পরিজনদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন টের পাওয়া গেল, ভিতরে ভিতরে অবস্থাটা বেশ গুমোট।
এলাকার পরিস্থিতি কেমন, সে সংক্রান্ত প্রশ্নটা অতএব করতেই হল। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার ‘অপরাধে’ কি আপনার উপরে হামলা হতে পারে? সুশান্ত সরকার বললেন, ‘‘এখানে কোনও আইনশৃঙ্খলা তো চলে না। যে কোনও সময় যে কোনও কিছু ঘটতে পারে। শুধু আমার উপরে নয়, আপনাদের উপরেও হামলা হতে পারে।’’
সুশান্তর পরিচিতি কিন্তু শুধু অসীমানন্দের ভাই হিসেবে নয়। তিনি বিজেপি নেতাও। অতএব এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা ব্যাখ্যাকে নিটোল সত্য হিসেবে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সুশান্ত সরকারের সঙ্গে কথোপকথন চলাকালীন তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যে ভাবে বার বার যাওয়া-আসা করতে লাগল বাইকে সওয়ার নজরদাররা, তাতে সুশান্তবাবুর ব্যাখ্যা সহজে উড়িয়েও দেওয়া গেল না।
বহু বছর ধরেই গোটা পরিবার হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার সঙ্গে। সাত ভাই। অসীমানন্দ মেজো, সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়েছেন ২৫ বছর বয়সে। এখন বয়স ৬৬। আর সুশান্ত সর্বকনিষ্ঠ। ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, সম্প্রতি বিজেপি-র জেলা সম্পাদক হয়েছেন। সুশান্তর দাবি, ৯০ বছরের মা আর স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে এখন। সুশান্তর মেজদা অসীমানন্দ ২০১০ সালে হরিদ্বারের আশ্রম থেকে মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। মামলায় বহু চড়াই-উতরাই হয়েছে। গত এক বছর ধরে জামিনে মুক্ত ছিলেন। তার আগে ২০১৬ সালে এক বার ১০ দিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেই সময়েই জয়রামবাটির অনন্যা লজে রাখা হয়েছিল অসীমানন্দকে। বিরাট নিরাপত্তা বাহিনী দেখে কামারপুকুর-জয়রামবাটি সেই প্রথম বার বুঝতে পেরেছিল, ভূমিপুত্র নবকুমার এখন কত বড় ‘ভিভিআইপি’!
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও উঠে এসেছে সেই ‘ভিভিআইপি’র প্রসঙ্গ। যাঁর নাম নাশকতার ঘটনায় জড়িয়েছিল, বিজেপি সেই অসীমানন্দকে এ রাজ্যে প্রচারে আনতে চাইছে বলে তিনিও যে শুনেছেন, মমতা সে ইঙ্গিত দেন এক সাক্ষাৎকারে। বিজেপির তীব্র সমালোচনাও করেন। তাতেই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন অসীমানন্দ।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং ঝাড়গ্রামে বিজেপি-র প্রভাব অনেকখানি বেড়েছে ইদানীং। বিজেপি নেতাদের দাবি, জঙ্গলমহলে বিজেপির ক্রমবর্ধমান প্রভাব খোদ তৃণমূলনেত্রীর উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। লালগড়ে বাঘ মারার ঘটনার পরে আদিবাসী সংগঠনের দুই নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে ডেকে পাঠিয়ে বৈঠক করেন। আদিবাসীদের যে কোনও সমস্যার সমাধান তিনি নিজে করবেন বলে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন। ওই বৈঠকের পর থেকে বিজেপি নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে অনেকে সারবত্তা খুঁজে পাচ্ছেন। তার পরেই সম্ভবত অসীমানন্দের নামটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে গেরুয়া শিবিরে।
সঙ্ঘের হয়ে মূলত আদিবাসী এলাকাতেই কাজ করেছেন অসীমানন্দ। এ রাজ্যে কাজ করেছেন বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-মেদিনীপুরে। বাইরে কাজ করেছেন ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থানে। কাজ করেছেন আন্দামানেও। আদিবাসী এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব বাড়তে না দেওয়ার দায়িত্ব ছিল অসীমানন্দের উপরে। সেই সূত্রে জনজাতীয় জীবনযাত্রা এবং ভাবাবেগ অত্যন্ত ভাল বোঝেন কামারপুকুর থেকে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাওয়া অসীমানন্দ। রাজ্য বিজেপি এখন সেটাকেই কাজে লাগাতে চাইছে।
বিজেপি নেতৃত্ব বলছেন, আদিবাসী এলাকায় দলের প্রভাব কমছে বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু যেটুকু জমি জঙ্গলমহলে তৈরি করা গিয়েছে, তা যে বিজেপি-ও সহজে ছাড়বে না, তেমন ইঙ্গিতও দলের নেতারা স্বাভাবিক ভাবেই দিচ্ছেন। সেখানেই ফের উঠে আসছে অসীমানন্দের নাম। আদিবাসী এলাকায় প্রভাব বাড়ানোর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা হিসেবে অসীমানন্দের কথা ভাবা হচ্ছে, সরাসরি এমন কোনও মন্তব্য বিজেপির তরফে করা হচ্ছে না। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের কথায় ইঙ্গিতটা বেশ স্পষ্ট। তিনি বলছেন, ‘‘অসীমানন্দ তো রাজনীতি করেন না। উনি সামাজিক, আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক। আমাদের রাজ্যের এখন যে রকম অবস্থা, তাতে এ রাজ্যে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন আনলে হবে না, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও দরকার। অসীমানন্দের মতো এক জনকে সেই লড়াইয়ে যদি আমরা সঙ্গে পাই, তা হলে ভালই হবে।’’
দিলীপ ঘোষের সঙ্গে অসীমানন্দের পরিবারের সম্পর্ক বহু বছরের। সঙ্ঘের কাজ করতে গিয়ে আলাপ। কামারপুকুরে অসীমানন্দের বাড়িতে একাধিক বার গিয়েছেন দিলীপবাবু। বললেন, ‘‘অনেক দিনের আলাপ। কয়েক মাস আগে ফোনে কথা হচ্ছিল। বলেছিলাম, বাংলায় যদি আপনাকে আমরা সঙ্গে পাই, ভালই হবে।’’ জবাবে কী বলেছেন অসীমানন্দ? দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘‘তখনও তো মামলাটা মেটেনি। উনি বলেছিলেন, সব মিটে যাক। তার পরে নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন।’’ এখন মামলা মিটে গিয়েছে। অসীমানন্দ বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তাঁর নিজের এলাকায় গুঞ্জনও বেড়েছে। চা দোকানের আড্ডায় বা সমমনস্কদের জমায়েতে ফিসফাস— ‘অসীমানন্দ কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গের আদিত্যনাথ।’
জঙ্গলমহল তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কী ভাবছেন অসীমানন্দকে নিয়ে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু নামটা নিয়ে চর্চা ক্রমশ বাড়ছে রাজ্যের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক শিবিরে।
ভিডিয়ো: অজয় রায়।