ওরা ঘরে ফেরে না।
ম্যাড়ম্যাড়ে পোস্টারে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মুখগুলো চোখে পড়ে। তবে ওইটুকুই। তাদের আর দেখা মেলে না।
জল-রোদ্দুরে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসা সেই সব শিশু-কিশোরেরা পুরনো স্মৃতির মতোই এক সময়ে আবছা হয়ে আসে। স্বজনের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গেই গুটিয়ে আসে পুলিশের তদন্ত। আর, শ্যামবর্ণ-ফুলছাপা স্কার্ট কিংবা চোখের তলায় কাটা দাগের মতো কিছু বিবরণ আর জন্মদাগের উল্লেখ নিয়েই চিরতরে হারিয়ে যায় তারা।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) হিসেবে প্রতি আট মিনিটে এক জন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রাম-শহরের আনাচ কানাচ থেকে এ ভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে শিশুরা।
এনআরবিসি-র হিসেব বলছে, দেশে প্রতি বছর অন্তত ৬০ হাজার শিশু হারিয়ে যায়। শিশু- হারানো এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এ রাজ্য। যাদের অন্তত ৪০ শতাংশই আর ঘরে ফেরে না।
কখনও হাসপাতালের শয্যা কখনও বা স্কুল ফেরত রাস্তা থেকে এমনকী বাবা-মা’র সঙ্গে মেলা কিংবা উৎসবের আঙিনা থেকেও এ রাজ্যে শিশু হারানোর ঘটনা ঘটছে আকছার।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা ব্যাখ্যা করছেন— ‘‘বলতে লজ্জা হয় তবে এটাই দস্তুর যে শিশু হারানোর পরিসংখ্যানের দিকে চোখ পড়লে বোঝা যায় রাজ্যে অপরাধ কী হারে বেড়ে গিয়েছে। কারণ, সমাজে সব থেকে দুর্বল শ্রেণি হিসেবে পরিচিত শিশুদের অপহরণই করে মুক্তিপণ চাওয়ার অপরাধের হারে শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।’’
কেন্দ্রীয় স্বারাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি রিপোর্ট বলছে, দিল্লি, নয়ডা, চণ্ডীগড় কিংবা মুম্বই, হয়দরাবাদেও শিশু অপহরণের ঘটনা কম নয়। কিন্তু আর্থিক ভাবে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ওই সব রাজ্যে অরহরণকারীদের খাঁই মিটিয়েই শিশুদের ফিরিয়ে আনার ‘রেওয়াজ’ রয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে ছবিটা অন্যরকম। শিশু-অপহরণের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও মুক্তিপণ দিয়ে নিজের সন্তানকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা অধিকাংশের নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিষ্পাপ শিশুটিকে খুন করে দায় আক্রোশ মেটায় অপরাধীরা। সেই তালিকায় শেষ সংযোজন, হাওড়ার সালকিয়ায় আট বছরের এক শিশু খুনের ঘটনা।
সালকিয়ার ওই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পুলিশের ‘অপদার্থতা’র চেহারাটাও। মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসার পরেই সালকিয়ার ওই পরিবার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তেমন গা করেনি। ফলে দিন দুয়েকের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল তার বস্তাবন্দি দেহ। ওই ঘটনার পরে সরকার অবশ্য মুখ বাঁচাতে হাওড়ার পুলিশ কমিশনারকে বদলি করে দেয়।
সালকিয়া-কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বীরভূমের মুরারইয়েও। গত ১৫ এপ্রিল গ্রামের চৈত্র সংক্রান্তির মেলা দেখার নাম করে অপহরণ করা হয়েছিল নেহা খাতুন (৭) নামে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে। ওই রাতেই নেহার বাবা, মুসা খানের কাছে ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসে। হাতে পায়ে ধরে মুরারই থানায় অভিযোগ করেন ওই ব্যক্তি। অভিযোগপত্রে মুক্তিপণ কোন ফোন নম্বর থেকে এসেছিল, তা-ও উল্লেখ করেন। কিন্তু পুলিশ তদন্তে গাফিলতি দেখাতে থাকে। অগ্যতা মুসা দ্বারস্থ হন এসডিপিও (রামপুরহাট)-র কাছে।
২২ এপ্রিল গ্রামেরই যুবক বাচ্চু শেখকে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক করে পুলিশ। কিন্তু, চার দিন আটক রাখার পরেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বাচ্চুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এর পরেও পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধারের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র তৎপরতা দেখায়নি। পুলিশি গাফিলতির অভিযোগ পেয়ে ৩০ এপ্রিল মুরাইয়ের ওসি পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের পদাবনতি ঘটিয়ে তাঁকে লাভপুর থানার থার্ড অফিসার করে পাঠিয়ে দেন জেলা পুলিশের কর্তারা। নতুন ওসি পার্থসারথি মণ্ডল দায়িত্ব নেওয়ার পরে নতুন করে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়। উদ্ধার হয় নেহার বস্তাবন্দি দেহ।
নদিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ক্রমান্বয়ে শিশু খুনের ঘটনার তালিকাও দীর্ঘ। কৃষ্ণগঞ্জের তারকনগর থেকে হাঁসখালির গাঁড়াপোতা কলাবাগান, বেথুয়াডহরির বুধবারের হাট— শিশু নিখোঁজের তালিকা দীর্ঘ। রাজ্যের জুভেনাইল বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য কুনাল দে যা দেখে বলছেন, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সই করে এসেছিল প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা দেবে বলে। তবে তা নিছকই প্রতিশ্রুতি। কেউ কথা রাখে না।’’