প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়া ভাঙড়ের সাবস্টেশন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
হাইটেনশন লাইন টানা থেকে সাবস্টেশনের নির্মাণ কাজ— বলতে গেলে ৯০ শতাংশই শেষ হয়ে গিয়েছে। ঠিক ছিল আর ক’মাসের মধ্যেই সাবস্টেশনটির সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ করে ফেলা হবে। কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনার পর রাজ্যের দীর্ঘতম এই গ্রিড প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কার্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। আর তার জেরে ভবিষ্যতে উন্নত মানের বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েক লক্ষ মানুষ।
পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন সূত্রে খবর— ফরাক্কা থেকে মুর্শিদাবাদের গোকর্ণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ সংবহন সংস্থার যে সাবস্টেশন রয়েছে, সেখান পর্যন্ত হাইটেনশন (৪০০/২০০ কেভি) লাইন টানার কাজ প্রায় শেষ। এর দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। গোকর্ণ থেকেই আরও একটি হাইটেনশন লাইন জোড়ার কাজ চলছিল রাজারহাট তথা ভাঙড় সাবস্টেশনের সঙ্গে। এর দূরত্ব প্রায় ২১০ কিলোমিটার। এখানেও লাইন টানার কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ হয়ে গিয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে। ওই লাইনও বারাসতের মুখ পর্যন্ত চলে এসেছে।
বিদ্যুৎ কর্তারাই বলছেন, নতুন এই গ্রিড করিডরের বিদ্যুৎ সংযোগ শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। কারণ ভাঙড়ে ৫০০ এমভিএ-র দু’টি ট্রান্সফর্মার নিয়ে মূল যে সাবস্টেশনটি হচ্ছে, তার নির্মাণ কাজ বেশ কিছু দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁদের কথায়, ভাঙড় সাবস্টেশনের সঙ্গে আবার দ্রুত যোগসূত্র তৈরির কাজ হচ্ছিল হুগলির জিরাট ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রাম সাবস্টেশনেরও। সেই কাজও প্রায় শেষের পথে। বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনের জেরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ না-হলে, জাতীয় গ্রিড থেকে রাজ্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার নতুন আরও একটি উৎসমুখ তৈরি হয়ে যেত। এখন জিরাট, খড়্গপুরের মতো হাতে গোনা কয়েকটি জায়গাতেই এটা রয়েছে। কিন্তু ভাঙড় সাবস্টেশন চালু না-হলে মার খাবে রাজারহাট, নিউ টাউন, সল্টলেক, কলকাতা-সহ দুই ২৪ পরগনার কয়েক লক্ষ বিদ্যুৎ গ্রাহক। বাড়বে না বিদ্যুৎ সংবহন ক্ষমতাও। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে কলকাতাকে ঘিরে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে তা সামাল দিতে হিমসিম খেতে হবে রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে।
প্রকল্পটি শেষ হলে
• কলকাতা ও লাগোয়া ২ জেলা বাড়তি বিদ্যুৎ পেত
• রাজ্যের সংবহন ক্ষমতা অনেক বেড়ে যেত
• রাজ্যে উত্তর-পূর্বের জলবিদ্যুৎ আসত
• রাজ্যের সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের নতুন উৎসমুখ হতো
• রাজ্যের বাড়তি বিদ্যুৎ বিক্রি সহজ হতো
• প্রকল্পটি বাতিল হলে জলে যাবে ৩০০ কোটি
কলকাতাকে ঘিরে আশেপাশের জেলাগুলিতে খুব দ্রুত নগরোন্নয়ন হচ্ছে। রাজ্যের হাতে বিদ্যুৎ থাকলেও সেই বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সাবস্টেশন প্রয়োজন। লাগবে বিদ্যুৎ আমদানি-রফতানি করার শক্তিশালী গ্রিড যোগাযোগ ব্যবস্থাও। ভবিষ্যতের রাজারহাট-নিউ টাউনের জন্য ভাঙড় ছিল সে ক্ষেত্রে একেবারে আদর্শ প্রকল্প। যে কারণেই ২০০৮-’০৯ সাল থেকে পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে এই প্রকল্পটি নিয়ে রাজ্য সরকার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। গ্রিডের এক কর্তা বলেন, ‘‘এই গ্রিডের গুরুত্ব রয়েছে অন্য দিকেও। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে সস্তার জলবিদ্যুৎও এই গ্রিডের মাধ্যমে আরও বেশি করে পশ্চিমবঙ্গে আনা যেত। আবার জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে অন্য রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গ বাড়তি বিদ্যুৎ বিক্রিও করতে পারত।’’
এই প্রকল্পের জন্য কম টাকা খরচ করছে না কেন্দ্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন! বিহারের পূর্ণিয়া থেকে ফারাক্কায় লাইন টেনে সেখান থেকে মুর্শিদাবাদের গোকর্ণ হয়ে ভাঙড়ের সাবস্টেশন পর্যন্ত এই প্রকল্প খাতে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ভাঙড় সাবস্টেশনের জন্য ৩০০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন গ্রিড কর্তারা। এর মধ্যে সাবস্টেশনের জন্য ১৩.৪৪ একর জমি কিনতে খরচ হয়েছে ১৯ কোটি টাকার মতো।
পশ্চিমবঙ্গের ৭টি জেলার ৮০টি গ্রামের উপর দিয়ে এই গ্রিড লাইনের মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। জেলাগুলি হল— দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, হুগলি, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম। সেখান থেকে হাইটেনশন লাইন ঝাড়খণ্ডের পাকুড় হয়ে বিহারে গিয়ে যুক্ত হবে পূর্ণিয়া সাবস্টেশনের সঙ্গে। আর পূর্ণিয়া থেকে ভাঙড় পর্যন্ত ৪০০/২২০ কেভি লাইনের এই বৃত্ত শেষ হয়ে গেলেই রাজ্যের সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের আরও একটি সংযোগ স্থাপন হতো। তাতে রাজ্যের বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষমতাও এক ধাক্কায় ৩০০০ মেগাওয়াট বেড়ে যেত।
সব কিছুই এখন অনিশ্চিত!