বিমানের গতি, বুড়ো হাড়ে একুশ কিলোমিটার

মাঘের মধ্যদিনেও মুখটা খানিক টকটকে হয়ে উঠেছে তাঁর। মৃদু হাঁপাতে হাঁপাতে এগোচ্ছেন ছিয়াত্তরের ‘যুবক’! ‘সে কী রে প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছেন তো! আর ক-তটা যাবেন!’ সহযাত্রীদের মধ্যে উসখুস। বুধবার বেলা সাড়ে ন’টায় চন্দ্রকোনা টাউন থেকে শুরু হয়েছিল মিছিল। দুপুর বারোটা নাগাদ কেশপুর ব্লকের মুখে। ‘এ বার একটু গাড়িতে উঠবেন তো!’ আমতা-আমতা করে কথাটা পাড়লেন বয়ঃকনিষ্ঠ কমরেড।

Advertisement

ঋজু বসু ও বরুণ দে

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২২
Share:

চন্দ্রকোনা থেকে কেশপুরের পথে বাম পদযাত্রায় বিমান বসু। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

মাঘের মধ্যদিনেও মুখটা খানিক টকটকে হয়ে উঠেছে তাঁর। মৃদু হাঁপাতে হাঁপাতে এগোচ্ছেন ছিয়াত্তরের ‘যুবক’!

Advertisement

‘সে কী রে প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছেন তো! আর ক-তটা যাবেন!’ সহযাত্রীদের মধ্যে উসখুস।

বুধবার বেলা সাড়ে ন’টায় চন্দ্রকোনা টাউন থেকে শুরু হয়েছিল মিছিল। দুপুর বারোটা নাগাদ কেশপুর ব্লকের মুখে। ‘এ বার একটু গাড়িতে উঠবেন তো!’ আমতা-আমতা করে কথাটা পাড়লেন বয়ঃকনিষ্ঠ কমরেড। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মেঘনাদ ভুঁইয়াকে দাবড়ে পাকা চুল ধুতি-পাঞ্জাবি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘বলেছি কি না, পুরোটা হাঁটব! এই জন্যই রেগে যাই।’’ সক্কলে সভয়ে সরে গেলেন।

Advertisement

কেশপুরের নেড়াদেউলে আধ ঘণ্টাটাক বিশ্রাম। দু’কাপ দুধ চা। ফের হণ্টন। বিমান বসু থামলেন বিকেল সাড়ে তিনটেয়। পুরো একুশ কিলোমিটার পথ পদব্রজে পার করে গরম জলে পা ধুলেন, কেশপুরে পার্টির জোনাল অফিস জামশেদ ভবনে।

বিমানবাবুর থেকে এক বছর বেশি বয়সে মহাকাশ-অভিযানে গিয়েছিলেন মার্কিন সেনা-অফিসার-কাম-সেনেটর-কাম নভোচর জন গ্লেন। আর সম্প্রতি জাপানের ইউচিরো মিউরা তো ৮০ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেছেন। তবু বাঙালি বলে কথা! চল্লিশ পেরোতে না-পেরোতেই যাদের গাঁটে-গাঁটে টান শুরু হয়ে যায়। ভুঁড়ি সামলে তখন চলাফেরাই দায়।

প্রবীণ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় যারপরনাই অবাক। এত বছরের ‘চেন স্মোকার’ কী করে এতটা হাঁটলেন? সুকুমারবাবুর বক্তব্য, ‘‘কার্ডিও পালমোনারি ফিটনেস দারুণ ভাল না হলে এটা সম্ভব নয়।’’ একমত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পুষ্পকেতু কোনার। দু’জনেই বলছেন, ‘বলতেই হবে বিমানবাবুর হৃদপিণ্ড একেবারে চাঙ্গা।’ শীতের আমেজটাও হণ্টনযজ্ঞের জন্য সহায়ক। তবে সুকুমারবাবুর মতে, বিমানবাবু নিশ্চয়ই অনেক কম বয়স থেকে ব্যায়াম করেন। সিগারেট খেলেও শৃঙ্খলার জীবনযাপন করেন। হাড়ের জোরও রয়েছে। না হলে এমন অভাবনীয় ঘটনা কস্মিনকালেও ঘটত না।

যাঁরা তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান-এর সংযম নিয়ে তাঁদের সন্দেহ নেই। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাসিন্দাটি মিতাহারী। মাংস পারতপক্ষে খান না। দুপুরে ভাত তো দূরের কথা! জলযোগের বদলে ফলযোগ সারেন। দুর্বলতা বলতে সিগারেট ছাড়া ক্বচিৎ-কদাচিৎ একটু মিষ্টি। নয়তো দফায়-দফায় দুধ-চিনিবিহীন চা-কফি। শখ করে আলিমুদ্দিনের ছাদে মরশুমি সব্জি ফলান। নিজের কাজ সব নিজে করেন। দলের জন্য হাঁটাহাঁটি, রক্তদান সর্বত্রই তিনি প্রথম সারিতে। এ দিন একুশ কিলোমিটার হেঁটে ফেলার পিছনে এ হেন অভ্যাসেরও যোগ দেখছেন অনেকে।

বিমানবাবুর থেকে বয়সে সামান্য বড় চুনী গোস্বামীও বুড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে ফুরিয়ে যাওয়ার যোগ মানতে নারাজ। এখনও নিয়মিত টেনিস, ক্লাবের আড্ডায় স্বাস্থ্যপানে সতেজ ময়দানি তারকা মুচকি হাসছেন, ‘‘মনের জোরটাই আসল।’’ ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মৌলিমাধব ঘটকের অবশ্য মৃদু আশঙ্কা, ‘‘মনের জোরে অতটা হেঁটে ফেললেও পরে পেশি বা হাড়ে সমস্যা হতে পারে। এই বয়সে এতটা হাঁটা ঝুঁকির।’’

চুনীর অবশ্য মত, ‘‘মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে, সমাজসেবা-ক্লাব-দল নিয়ে মেতে থাকলে বয়স দাঁত ফোটাতে পারে না! বাড়ি বসে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করলে লোকে বুড়িয়ে যায়।’’ শুনে কারও কারও বিমানবাবুর আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথাও মনে পড়তে পারে। তিনি অকৃতদার!

প্রবীণ বাম নেতার হাঁটার নজির খানিক ইতিহাসও উসকে দিচ্ছে। সাতাত্তর বছর বয়সে লাঠিধারী গাঁধীর নোয়াখালি অভিযান এ দেশের ইতিহাসে চিরখোদাই হয়ে আছে। ভূদান আন্দোলনের সুবাদে স্মরণীয় গাঁধী-শিষ্য বিনোবা ভাবেরও হাঁটিয়ে হিসেবে নাম-ডাক ছিল।

রাজনীতির কারবারিরা মনে করাচ্ছেন, বিমানবাবুর প্রতিপক্ষ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হাঁটার জন্য পাগল। ট্রেডমিলে হাঁটেন। কলকাতার লেক, উত্তরবঙ্গের পাহাড়-ডুয়ার্স থেকে বিলেত— হাঁটার সুযোগ পেলে গাড়িতে চলেন না। রাজনীতির তাগিদে হাঁটার হিড়িকে মাতছেন বিজেপি নেত্রী তথা অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ও। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি দলের মহিলা মোর্চার সঙ্গে তাঁর গন্তব্য, কামদুনি থেকে পার্ক স্ট্রিট হয়ে কাকদ্বীপ। রূপা অবশ্য বিমানবাবুর হাঁটুর বয়সী।

এত আঁকজোক অবশ্য বিমানবাবুর মাথায় নেই। ‘‘আমি তো বরাবরই হাঁটি,’’ বলেই খোশমেজাজে তিনি। কখনও যানজটে আটক বাসযাত্রীদের মিনতি ‘একটু মানিয়ে নিন’! কখনও বা তরুণ কমরেডদের সঙ্গে ঠাট্টা, ‘কী কষ্ট হচ্ছে না তো!’ বার্ধক্য-বিজ্ঞান বিশারদ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর মতে, প্রবল মোটিভেশন বা কাজের প্রতি নিষ্ঠায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ বয়স ভুলে গিয়েছেন। বিমানবাবুর কমরেডদের মতে, দলের দায়বদ্ধতাটাই প্রবীণ নেতার খুড়োর কল। রাজনীতির লাভের অঙ্কে এখন এ হাঁটা কত দূর কাজে আসে, সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন