BIS Report

বিপদে পাহাড়! ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসাবে আশঙ্কাজনক স্থানে দার্জিলিং-কার্শিয়াং, নিরাপদ নয় কলকাতাও, বলছে রিপোর্ট

দেশের কোন কোন জায়গা কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ, তা চিহ্নিত করতে ‘সিসমিক জ়োন’–এর যে তালিকা এত দিন ধরে ছিল, তার বড়সড় পরিবর্তন করা হয়েছে নতুন রিপোর্টে। মানচিত্রে যোগ হয়েছে নতুন একটি অঞ্চল, যাকে বলা হচ্ছে ‘জ়োন–৬।’

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:১৬
Share:

আশঙ্কার কথা জানাল ‘ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস’ (বিআইএস)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

গত অক্টোবরেই প্রবল বৃষ্টিতে ধস নেমেছিল পাহাড়ে। প্রাণহানি হয়েছিল অনেকের। সেই দার্জিলিং নিয়ে নতুন আশঙ্কার কথা জানা গেল ‘ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস’ (বিআইএস)-এর সৌজন্যে। সম্প্রতি গোটা ভারতের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলিকে নতুন করে চিহ্নিত করেছে তারা। তাতে আশঙ্কাজনক জায়গায় আছে কলকাতাও।

Advertisement

কম্পনের ঝুঁকি এবং ভূমিকম্প-প্রতিরোধী কাঠামোর নকশার মানদণ্ড সংক্রান্ত সপ্তম পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া বিআইএসের রিপোর্টে বাংলার দার্জিলিং নিয়ে যেমন আশঙ্কার কথা বলা রয়েছে, তেমনই তালিকায় আছে সমগ্র উত্তরাখণ্ড রাজ্য। বস্তুত, দেশের কোন কোন জায়গা কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ, তা চিহ্নিত করতে ‘সিসমিক জ়োন’–এর যে তালিকা এত দিন ধরে ছিল, তার বড়সড় পরিবর্তন করা হয়েছে নতুন রিপোর্টে। মানচিত্রে যোগ হয়েছে নতুন একটি অঞ্চল, যাকে বলা হচ্ছে ‘জ়োন–৬।’

এত দিন গোটা দেশের কম্পনপ্রবণ এলাকা চারটি ‘জ়োন’ বা অঞ্চলে ভাগ করা হত। এদের মধ্যে জ়োন–২ মানে সবচেয়ে নিরাপদ এবং জ়োন–৫ হল সবচেয়ে বিপজ্জনক। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির মানচিত্র অনুযায়ী, ‘হাইয়েস্ট রিস্ক জ়োন’ বা সর্বোচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে ‘জ়োন–৫’। গোটা হিমালয় পর্বতমালাকে ‘সর্বোচ্চ ভূমিকম্পপ্রবণ’ এলাকায় রাখা হত। এখন নয়া সংযোজন ‘জ়োন–৬’-এর আওতায় ফেলা হয়েছে হিমালয় পর্বতমালাকে। তাতে রয়েছে বাংলার দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং–সহ পূর্ব হিমালয় অঞ্চল। আছে পুরো উত্তরাখণ্ড। রয়েছে সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশও। নয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ভূমির ৬১ শতাংশ এখন মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (কম্পন) অঞ্চলে অবস্থিত। যা কয়েক দশকের মধ্যে বড় পরিবর্তন।

Advertisement

বিআইএসের রিপোর্ট বলছে, দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং, সিকিম এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে কাশ্মীরের একাংশ থেকে অরুণাচল প্রদেশ হয়ে মায়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের সিংহভাগই এখন অতি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। নতুন মানচিত্র প্রকাশের পর পরিবেশবিদ থেকে ভূ-বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আগের চেয়ে আরও বেশি ‘উত্তেজিত’ পাহাড়ের ভূস্তর। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। তাঁরা দুষছেন অনিয়ন্ত্রিত এবং অবৈজ্ঞানিক ভাবে তৈরি নির্মাণ, নদীর মুখ এবং প্রবাহপথ আটকে দেওয়া এবং পাহাড় কেটে সড়ক, টানেল নির্মাণ ইত্যাদিকে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, নদীবাঁধ থেকে বড় বড় কাঠামো যে ভঙ্গুর মাটি এবং শিলার উপরে তৈরি হয়েছে, সে সব নিয়ে এ বার গভীর ভাবে ভাবার সময় এসেছে। দরজায় কড়া নাড়ছে বিপদ। তাঁরা জানাচ্ছেন, যে ভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হচ্ছে, নদীকে শাসন করা হচ্ছে, নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে, সেখান থেকে জলদি সরে আসতে হবে আমাদের।

এই পাঁচটি অঞ্চলের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে কলকাতা। জ়োন-চার-এ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর।

ভূগোলের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায়ের কথায়, ‘‘এখনই যদি কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন সজাগ না হয়, ভবিষ্যতে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। পাহাড়ি অঞ্চলে নির্মাণবিধি আরও কঠোর করা দরকার। জোর দিতে হবে ব্যাপক সবুজায়ন এবং ভূমিক্ষয় রোধের উপর। ‘হট স্পট’ চিহ্নিত করে জাপানের মতো উন্নত ভূমিকম্প-প্রতিরোধ প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। তবেই বাঁচবে পাহাড়।’’

একই কথা বলছেন, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘ভূমিকম্প সম্পর্কে সাম্প্রতিক রিপোর্ট খুবই উদ্বেগের। দার্জিলিং-সহ গোটা পূর্ব ভারত এখন সিসমিক জ়োন-৬-এ। তাই পাহাড় এখন আরও বেশি ঝুঁকির।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ভূমিকম্প আমরা আটকাতে পারব না। কিন্তু প্রাণ এবং সম্পত্তিহানি রোখার উপায় তো আমাদেরই খুঁজে বার করতে হবে। পুরনো যে সমস্ত নির্মাণ রয়েছে, সেগুলোর সংস্কার আশু প্রয়োজন। নতুন নির্মাণ তৈরির সময়েও ভূমিকম্পের বিপদের কথা মাথায় রাখতে হবে।’’

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঞ্জন রায় জানান, পরিবেশকে ধংস করে পাহাড়ের উপর অবৈজ্ঞানিক ভাবে যে ভাবে বহুতল তৈরি হয়েছে, উন্নয়নমূলক প্রকল্প করা হয়েছে, তাতে আরও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন তৈরি হয়েছে। দুর্বল শিলাস্তর রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে৷ উন্নয়নের নামে হিমালয়ের উপর যে ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছে, তা বন্ধ করতে হবে।

নতুন রিপোর্ট সম্পর্কে অবগত জিটিএ-র মুখপাত্র এসপি শর্মা। তিনি বলেন, ‘‘দার্জিলিং শহরের পরিধি বাড়াতে হবে। শহরকে বাড়াতে গেলে যে পরিমাণ জমির দরকার, তা হয় চা-বাগানের মধ্যে রয়েছে, না-হলে বনাঞ্চলে। এই সমস্যার কারণেই বছরের পর বছর এই ধরনের অসংখ্য বহুতল তৈরি হয়েছে। আমরা নতুন টাউনশিপের কথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও করেছি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, দার্জিলিঙে নতুন টাউনশিপ গড়ে তোলা হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি চা-বাগানকে চিহ্নিত করা হয়েছে নতুন টাউনশিপ তৈরির জন্য।’’ তিনি জানান, পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে আশির দশক থেকে বহু নির্মাণ তৈরি হয়েছে দার্জিলিঙে। জমির মালিকানা ইত্যাদি দেখে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে না এলে এমন বহুতল থেকেই যাবে। তার চাপ পড়বে পাহাড়ের বুকে।’’

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, আতঙ্কিত না হয়ে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। তাঁরা বলছেন, সিসমিক জ়োন-৬-এ ইন্দোনেশিয়া থেকে চিনের মতো দেশও আছে। তাদের মতোই পরিকল্পনা করতে হবে যাতে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement