(বাঁ দিক থেকে) মুকুল রায়, বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রের দলত্যাগী বিজেপি বিধায়ক মুকুল রায়ের বিধায়কপদ খারিজের নির্দেশ নিয়ে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেওয়ার মুখে। মুকুল রায়ের বিধায়কপদ বাতিল সংক্রান্ত কলকাতা হাই কোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে বিধানসভার সচিবালয়। সেই ইঙ্গিত মিলতেই রাজনীতির মঞ্চে বাড়ছে উত্তাপ।
বিধানসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে কি না, তা নিয়ে গত কয়েক দিনে তৎপরতা বেড়েছে। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই একাধিক বরিষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সোমবার সন্ধ্যায় বিধানসভায় এসে স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক করেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত। আইনগত দিক থেকে সম্ভাব্য পদক্ষেপ, রায়ের প্রভাব এবং আপিলের ভিত্তিগুলি নিয়ে ওই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয় বলে জানা গিয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে বিধানসভার সচিবালয় বা স্পিকার সুপ্রিম কোর্টে গেলে যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, তা অনুমান করেই প্রস্তুতি শুরু করেছে বিজেপিও। কারণ, এই মামলা মূলত বিজেপির দুই বিধায়কের তরফেই দায়ের করা হয়েছিল। সেই মামলার ভিত্তিতেই আদালত মুকুলের বিধায়কপদ খারিজ করে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই আপিলকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের নতুন অধ্যায় হিসাবে দেখছে বিরোধীদল।
বিজেপির পরিষদীয় দলে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, বিধানসভার সচিবালয় বা স্পিকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেই পাল্টা পদক্ষেপ করা হবে। বিজেপি মনে করছে, স্পিকার যদি আপিল করেন, তবে সেটি হবে মুকুলকে রক্ষা করার রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। এই প্রসঙ্গে মামলাকারী বিজেপি বিধায়ক অম্বিকা রায় বলেন, “আবেদনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তবে আমরা প্রস্তুত। স্পিকার বা বিধানসভা কর্তৃপক্ষ যদি উচ্চ আদালতে যান, তবে তার পাল্টা আবেদনের জন্য আমরা আইনগত ভাবে তৈরি হচ্ছি।” তাঁর মন্তব্য, “স্পিকার যদি সুপ্রিম কোর্টে যান, তা হলে স্পষ্ট হবে যে তিনি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া এক বিধায়কের পদ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।”
তৃণমূল পরিষদীয় দলের একটি সূত্র বলছে, মুকুল রায় এখন যে দলেই থাকুন, বিধানসভা একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তার নিজস্ব ক্ষমতা ও অধিকার রয়েছে। তাই আদালতের রায়ে বিধানসভার কোনও অধিকার খর্ব হয়েছে কি না, সেটাই এখন আইনগত ভাবে পর্যালোচনা করা জরুরি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, সাংবিধানিক প্রশ্নই এখানে বড়— এমনটাই দাবি শাসক শিবিরের।
অন্য দিকে, বিজেপি পরিষদীয় দল জানিয়েছে, এই লড়াই এখন নীতি ও আইনের লড়াই। নির্বাচিত প্রতিনিধি দলত্যাগ করলে তার পরিণতি কী হবে, সেই প্রশ্নে কোনও রকম নমনীয়তা দেখাতে রাজি নয় তারা। ফলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হলে আবারও বড় আইনি সংঘাতে নামতে চলেছে উভয়পক্ষ।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন মুকুল রায়। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই জুন মাসে তিনি পুনরায় তৃণমূলে যোগ দেন। এর পরই তাঁর বিধায়কপদ খারিজের দাবি তোলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন জানান, দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুসারে মুকুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ফল না পেয়ে মুকুলের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইনে মামলা করেছিলেন শুভেন্দু। প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়। কিন্তু শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, এই মামলা কলকাতা হাই কোর্টে করতে হবে। এর পর শুভেন্দুরা উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। মুকুল পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান পদে কেন থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পৃথক মামলা করেছিলেন বিজেপির কল্যাণীর বিধায়ক অম্বিকা রায়। দু’টি মামলার শুনানি হয় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির বেঞ্চে। গত বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণা করেছে। দলত্যাগ বিরোধী আইনে খারিজ করা হয়েছে মুকুলের বিধায়কপদ।
কলকাতা হাই কোর্ট স্পিকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুকুলের বিধায়কপদ খারিজের নির্দেশ দেয়। আদালতের এই রায়েই রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা কিছু একটা ভাবছি, কী করা যায়।” বিধানসভা সূত্রের খবর, স্পিকার ইতিমধ্যেই রাজ্যের এজির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পুরো বিষয়টি আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিধানসভা সচিবালয়ও হাই কোর্টের রায়ের উপর আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। আপিল দায়ের করলে মুকুল রায়ের বিধায়কপদ খারিজের রায় আপাতত স্থগিতও থাকতে পারে, এমন মত আইন বিশেষজ্ঞদের।
উল্লেখযোগ্য, শুধু মুকুল রায় নন—২০২১ সালে নির্বাচিত আরও কয়েক জন বিজেপি বিধায়ক দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেন। সুমন কাঞ্জিলাল, তন্ময় ঘোষ, হরকালী প্রতিহার ও তাপসী মণ্ডলের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইনে পদ খারিজের আবেদন ইতিমধ্যেই স্পিকারের কাছে জমা দিয়েছে তৃণমূল পরিষদীয় দল। সেই আবেদনগুলিও এখনও নিষ্পত্তিহীন। হাই কোর্টের রায়ের পর এখন সেই মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি আরও জোরদার হবে বলেই রাজনৈতিক মহলের মত।