West Bengal News

‘গোটা মাঠ দাপালেও উন্নয়নের বিকল্প মডেল ছাড়া জিতবে না বিজেপি’

সকাল থেকেই ফুরফুরে মেজাজ কলকাতার ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া বাড়িটায়। জয়ের সম্ভাবনা নেই, সকলেই জানতেন। তবুও যে কোনও ভোটগণনার সকালই রাজনীতির মানুষদের কাছে উৎসাহের বিষয়। তাই দক্ষিণ কাঁথি উপনির্বাচনের ফল জানতে সকাল থেকেই টেলিভিশনে চোখ ছিল রাজ্য বিজেপির সদর দফতরের।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৭ ১৭:৩৭
Share:

উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ রয়েছে বিজেপির, তবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এখনও অনেক পথ পেরতে হবে। —ফাইল চিত্র।

সকাল থেকেই ফুরফুরে মেজাজ কলকাতার ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া বাড়িটায়। জয়ের সম্ভাবনা নেই, সকলেই জানতেন। তবুও যে কোনও ভোটগণনার সকালই রাজনীতির মানুষদের কাছে উৎসাহের বিষয়। তাই দক্ষিণ কাঁথি উপনির্বাচনের ফল জানতে সকাল থেকেই টেলিভিশনে চোখ ছিল রাজ্য বিজেপির সদর দফতরের। বেলা যত গড়িয়েছে, তৃণমূল ব্যবধান ততই বাড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিজেপি দফতরের মেজাজটা সেই ফুরফুরেই থেকে গিয়েছে। কারণ দিলীপ ঘোষের কথায়: ‘‘এত দিন শুধু আমরা বলছিলাম, এ বার বাংলার মানুষও প্রমাণ করে দিলেন— তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ আমরাই।’’

Advertisement

দক্ষিণ কাঁথি শুধু নয়, গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেই বিজেপি দুর্বল, আর তৃণমূল প্রবল প্রতাপশালী। তার উপরে আবার উপনির্বাচনে সব সময়েই অ্যাডভান্টেজ শাসক দল। দক্ষিণ কাঁথির লড়াইয়ে খুব বেশি শক্তিক্ষয় করতে রাজি ছিল না বিজেপি। প্রচারে তেমন জোর দেওয়া হয়নি, হেভিওয়েটরাও সে ভাবে কাঁথির দিকে নজর দেননি। তাই বৃহস্পতিবার ভোটের ফলের দিকে আঙুল দেখিয়ে রাজ্য বিজেপির নেতারা মুচকি হেসে যা কিছু বলছেন, তার সারকথা হল একটা প্রশ্ন— দেখলেন তো, কী ভাবে হেলায় দু’নম্বরে উঠে এলাম? বাম-কংগ্রেসকে অনেক পিছনে ফেলে বাংলায় এখন প্রধান বিরোধী শক্তি বিজেপিই, দাবি দলটির রাজ্য নেতৃত্বের। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল গদিছাড়াও হচ্ছে— এমন কথাও বলতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবিরের একটি অতি-উৎসাহী মহল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূলকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে ফেলে দেওয়ার পর্যায়ে বিজেপি এখনও পৌঁছয়নি।

অধ্যাপক শিবাজীপ্রতিম বসু মনে করছেন, দক্ষিণ কাঁথিতে তৃণমূলের জয়কে ছোট করে দেখার কোনও কারণ নেই। তাঁর কথায়: ‘‘কাঁথি দক্ষিণ কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস ৪২ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছে এটা নিশ্চয়ই তাদের শ্লাঘার কারণ।’’ তৃণমূল যে বড় ব্যবধানে জিতবে, তা অনুমেয়ই ছিল বলে মনে করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথা রাজনৈতিক ভাষ্যকার শিবাজীপ্রতিম। তবে গতবারের তুলনায় জয়ের ব্যবধান বাড়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূচক বলেই তাঁর মত।

Advertisement

এ তো গেল তৃণমূলের কথা। বিজেপির ফলাফলকে কি উত্থান হিসেবে দেখছেন তিনি? শিবাজীপ্রতিম বসু বললেন, ‘‘বামশক্তিকে প্রায় অগ্রাহ্য করে, কংগ্রেসকে ফুৎকারে উড়িয়ে ৫২ হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসাটা অবশ্যই বিজেপির চমকপ্রদ উত্থান।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘মোদী ম্যাজিকের ঢেউ যে পূর্বকূলের রাজ্যগুলিতেও আছড়ে পড়তে শুরু করেছে, তার ইঙ্গিত ওড়িশার গ্রামীণ ভোটে পেয়েছিলাম। সেই ঢেউয়ের ছোঁয়াচ এ রাজ্যেও অন্য রকম বার্তা নিয়ে এল।’’

আর এক অধ্যাপক তথা সেফোলজিস্ট বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পরেও কিন্তু বিজেপি এ রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট বাঁধতেই আবার বিজেপি তৃতীয় স্থানে চলে যায়। বিধানসভায় বাম-কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় বিজেপিকে আবার সামনে এগিয়ে দিয়েছে। কোচবিহারের উপনির্বাচনেও বিজেপি এগিয়ে এসেছিল। দক্ষিণ কাঁথিতেও তাই হল। এর থেকে প্রমাণ হচ্ছে, তৃণমূল-বিরোধী ভোটাররা এখন দোদুল্যমান।’’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়— দক্ষিণ কাঁথির এই ফলাফলে অবশ্যই প্রমাণ হয় যে বিজেপির ভোট বাড়ছে, রাজ্য রাজনীতিতে তার প্রভাবও পড়বে। কিন্তু তাতে তৃণমূলের খুব একটা ক্ষতি হবে বলে অধ্যাপক চক্রবর্তী মনে করেন না। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ৩৮ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল। লোকসভায় পেয়েছিল ৩৯ শতাংশ। বিধানসভা নির্বাচনে পেল ৪৫ শতাংশ। আর তার পরের উপনির্বাচনগুলোতে ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোট পাচ্ছে তৃণমূল। অর্থাৎ নিজের ভোট ক্রমশ বাড়িয়ে নিচ্ছে শাসক দল।’’

তা হলে বিজেপির ভোট বাড়ছে কোন সমীকরণে? বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর জবাব, ‘‘বিজেপি সেই ভোটটাই পাচ্ছে, যেটা বিরোধী শিবিরে রয়েছে। তৃণমূলকে যাঁরা চান না, তাঁরা বিজেপির দিকে জড়ো হচ্ছেন। যখন মনে হচ্ছে বাম-কংগ্রেস তৃণমূলকে হারাতে পারবে, তখন এই ভোটাররা বাম-কংগ্রেসের দিকে যাচ্ছেন। যখন মনে হচ্ছে বিজেপি-ই তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ, তখন তাঁরা বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন। অর্থাৎ এখন যা অবস্থা, তাতে বিজেপি একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত নিজেদের ভোট বাড়াতে পারবে। কিন্তু তাতে তৃণমূলকে হারানোর জায়গায় তারা পৌঁছতে পারবে না। কারণ তৃণমূল নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক তো ধরে রাখছেই। ধীরে ধীরে তা বাড়িয়েও নিচ্ছে।’’

কী ভাবে ভোট বাড়াচ্ছে তৃণমূল? অধ্যাপক চক্রবর্তীর বাখ্যা, ‘‘বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের আওতায় রাজ্যের মানুষকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টাকা, সাইকেল, কম দামে চাল, আরও নানা কিছু। যাঁরা এই সুবিধাগুলো পাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু তৃণমূল ছেড়ে নড়বেন না। এবং এই সব সুবিধা পাওয়ার জন্যই আরও কেউ কেউ তৃণমূলে ভিড় জমাবেন। বামেরাও ক্ষমতায় আসার পর ভূমিসংস্কার, সমবায় ইত্যাদি চালু করে একটা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছিল। সেই সুবিধাভোগীরা বহু বছর বাম শিবির ছেড়ে নড়েননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঠিক একই রকম ভাবে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে ফেলেছেন।’’ অধ্যাপক চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বিজেপি এ রাজ্যের বিরোধী ভোটটাকে নিজের দিকে আনতে পারবে হয়তো, কিন্তু তৃণমূলের ভোটে ভাগ বসানো তাদের পক্ষে কঠিন।’’

ধীরে ধীরে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে বিজেপি। তবে ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন ধরে রাখা খুব সহজ কাজ নয়। —ফাইল চিত্র।

কিছু দিন আগে কোচবিহার লোকসভার উপনির্বাচনে বা আজ দক্ষিণ কাঁথির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বামেদের ভোটব্যাঙ্ক দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী?

অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘এই মুহূর্তে বাংলায় বামপন্থীদের আর কোনও নিজস্ব রাজনীতি নেই। সেই কারণেই বামেরা ক্রমশ পিছু হঠছেন।’’ উদয়নবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায়। তাই তাদের একটা নির্দিষ্ট ভোটব্যাঙ্ক থাকবেই। কিন্তু যাঁরা তৃণমূলকে চান না, তৃণমূলের বিকল্প খুঁজছেন, তাঁরা বিজেপি-তেই অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছেন। কারণ বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় রয়েছে। বাম-কংগ্রেস ছেড়ে অনেকেই বিজেপির দিকে চলে যাচ্ছেন।’’

আরও পড়ুন: গড় বাঁচল, ভোট বাড়ল, চিন্তাও বাড়ল তৃণমূলের

বিজেপির এই উত্থানে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণেরও ভূমিকা রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত। শিবাজীপ্রতিম বসুর কথায়, ‘‘কেবল সিপিএম বা তৃণমূলের রাজনৈতিক বিরোধিতা করে বা মোদীর ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নে প্রভাবিত হয়ে নয়, এই সাফল্য এসেছে রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল, অস্ত্র হাতে দিলীপ ঘোষদের আস্ফালন বা বাংলায় অশ্রুত হনুমান জয়ন্তী পালন করে।’’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত। তিনি বললেন, ‘‘শুধুমাত্র আবেগ আর উত্তেজনার রাজনীতি করে কিন্তু তৃণমূলকে গদি থেকে সরানো যাবে না। ভোট অনেকটা বাড়বে, কিন্তু উন্নয়নের বিকল্প মডেল সামনে না রাখতে পারলে, বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’’ বিশ্বনাথবাবুর কথায়, ‘‘এই ভাবে চললে, বিজেপি গোটা মাঠ জুড়ে খেলবে, কিন্তু গোলপোস্টের সামনে গিয়ে বলটাকে আর জালে জড়িয়ে দিতে পারবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন