CPM Brigade Rally

মোদী-মমতাকে একযোগে তোপ, দুঃসময়ের ব্রিগেডে বৃহত্তর বাম ঐক্যের বার্তা

এ দিনের সমাবেশের শেষ বক্তা ছিলেন রায়গঞ্জের সাংসদ তথা সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। মোদী এবং মমতাকে ‘হিটলারের নাতি-পুতি’ বলে আক্রমণ করেন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২০:২৭
Share:

ব্রিগেডের মঞ্চে বাম নেতারা। ছবি: পিটিআই।

একের পর এক নির্বাচনে ভরাডুবি। সংগঠনে টানা রক্তক্ষরণ। বেশ কয়েকটা জনমত সমীক্ষায় ইঙ্গিত, আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বামেদের আসনসংখ্যা শূন্যে পৌঁছতে পারে। এমন এক ঘোর দুঃসময়ে ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিতে পারাই বড়সড় দুঃসাহসের পরিচয়। সেই দুঃসাহসী সমাবেশের ডাক— দিল্লি থেকে সরাতে হবে মোদীকে, বাংলা থেকে দিদিকে। বৃহত্তর বাম ঐক্যের বার্তাও শোনা গেল ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে। আর লাল মঞ্চকে আরও লাল করে দিয়ে গেলেন লালমাটির নেত্রী দেবলীনা হেমব্রম।

Advertisement

রবিবার বেলা ১টায় ব্রিগেড সমাবেশের মূল পর্ব শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিছুটা দেরিতেই তা শুরু হয়। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, ফরওয়ার্ড ব্লকের সর্বভারতীয় নেতা দেবব্রত বিশ্বাস, সিপিআই সাধারণ সম্পাদক সুধাকর রেড্ডি, আরএসপির ক্ষিতি গোস্বামীরা শুরুতেই ভাষণ দেন। তাঁদের পরে ভাষণ দিতে ওঠেন এ দিনের সমাবেশের অন্যতম প্রধান বক্তা তথা সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। ‘জনতার ব্রিগেডে’-এর রাজনৈতিক লাইনটা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন তিনি। এ দিনের জমায়েতকে প্রথমে ‘লাল সমুদ্র’ বলে আখ্যা দেন ইয়েচুরি। তার পরে বলেন, ‘‘এই লাল সমুদ্র দেখে আমার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে, শুধু আমার নয়, গোটা দেশের বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে যে, বাংলার মানুষ দিল্লি থেকে মোদীকে হঠাবেই, বাংলা থেকে মমতাকে হঠাবেই।’’ নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল একে অপরের পরিপূরক রাজনীতি করেন বলে এ দিন ফের দাবি করেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক। মোদীকে ‘পকেটমার’ বলে কটাক্ষ করেন ইয়েচুরি। তার পরে বলেন, ‘‘পকেটমার কিন্তু একা কাজ করে না, একজন সহকারী থাকে। ধরা পড়ে গেলে ওই সহকারীই পকেটমারকে পালাতে সাহায্য করে।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী পরস্পরকে সে ভাবেই সাহায্য করছেন— কটাক্ষ ইয়েচুরির।

সিপিএম সাধারণ সম্পাদকের পরের বক্তা ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। এই প্রথম বার বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দিল লিবারেশন। দীপঙ্করকে আমন্ত্রণ জানানো এবং সে আমন্ত্রণ স্বীকৃত হওয়ার মধ্যেই বৃহত্তর বাম ঐক্যের ইঙ্গিত ছিল। দীপঙ্করের ভাষণেও ছিল ঐক্যের সুর। তাঁর দল বামফ্রন্টে নেই, কিন্তু বৃহত্তর বাম ঐক্যের স্বার্থেই তিনি ব্রিগেড সমাবেশে হাজির হয়েছেন— স্পষ্ট করেই বলেন দীপঙ্কর। জমায়েতের উদ্দেশে দীপঙ্করের মন্তব্য, ‘‘আপনারা আবার প্রমাণ করলেন, পশ্চিমবাংলার মাটিতে বামপন্থার ভিত কতটা শক্ত।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: অমিতের পর যোগীর কপ্টারও নামতে দিল না রাজ্য সরকার​

গোটা দেশের রাজনৈতিক শিবিরই দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে সুবক্তা হিসেবে চেনে। পশ্চিমবঙ্গে এত বড় কোনও সমাবেশে দীপঙ্করের ভাষণ এই প্রথম। ফলে তাঁকে নিয়ে বিস্ময় কিছুটা ছিলই। কিন্তু আরও বড় বিস্ময় এ দিন ঝুলি থেকে বার করল সিপিএম। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা রানিবাঁধের প্রাক্তন বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রম ছিলেন এ দিনের বক্তাদের তালিকায়। বিমান বসু ঘোষণা করেছিলেন যে, সাঁওতালি এবং বাংলায় ভাষণ দেবেন রাজ্য কমিটির সদস্যা দেবলীনা। দেবলীনা কি একবার সাঁওতালিতে বলবেন, আর এক বার বাংলায়? জল্পনা শুরু হয়েছিল ভিড়ের মধ্যে? কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উচ্চগ্রামে বেঁধে রাখা টানটান ভাষণে দেবলীনা যে রকম অনায়াস দক্ষতায় সাঁওতালি আর বাংলা মিশিয়ে দিলেন, তাতে অনেক শহুরে বাঙালিও বেশ খানিকটা বুঝে গেলেন জঙ্গলমহলের ভাষা।

দেবলীনার এ দিনের ভাষণ ছিল দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। আবেগে ঠাসা ভাষণটায় তিনি যেন এ দিন হয়ে উঠলেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অকাট্য কণ্ঠস্বর। বাজেটে কৃষকদের জন্য মোদী সরকারের যে ঘোষণা, তা দেশ জুড়ে বামপন্থীদের কৃষক আন্দোলনের জেরেই— বললেন দেবলীনা। আর বাংলার জঙ্গলমহলে আদিবাসীদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যা কিছু করেছেন বলে দাবি করা হয়, সে সবই ‘ঢপবাজি’ বলে মন্তব্য করলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা গান বাঁধতে পারি, সুর বাঁধতে পারি। কারও দয়ার দান আমাদের দরকার নেই।’’ আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা এবং কাজের ব্যবস্থা করার পক্ষে জোর সওয়াল করেন দেবলীনা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হতে চান হন, আপত্তি নেই, আদিবাসীদের অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া হোক— দাবি রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর। জঙ্গলমহলে মাদল বিলির সরকারি কর্মসূচিকে কটাক্ষ করে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মাদল কি আমরা চিবিয়ে খাব?’’

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রও অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ছিলেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘কিছু দিন আগে এখানে একটা সভা হয়েছিল, ২৩ জন বক্তা ছিলেন। আজ ৯ জন বক্তা, অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম। কিন্তু শোনার লোক দ্বিগুণেরও বেশি।’’ ব্রিগেডের এই সমাবেশ লোকসভা নির্বাচনের দিকে চোখ রেখেই। তাই সুরটা বিজেপির বিরুদ্ধে বাঁধা জরুরি ছিল। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তাই বললেন, ‘‘আগে দিল্লি থেকে বিজেপি-কে হঠাতে হবে। আর দিল্লি থেকে বিজেপি-কে হঠানো গেলে মুখ্যমন্ত্রীকে ঠেলে ফেলে দিতে সময় লাগবে না।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পনীতিকে তীব্র আক্রমণ করেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘শিল্পতাড়ুয়া সরকার, রাজ্য থেকে শিল্প তাড়াচ্ছেন। আপনি থাকলে বাংলায় এক পয়সাও বিনিয়োগ আসবে না।’’

আরও পড়ুন: রাজীব কুমারের বাংলোয় সিবিআই অফিসাররা, তুলে নিয়ে গেল পুলিশ, ঘটনাস্থলে মমতা

নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছিলেন, ‘‘চালুনি আবার সূচের বিচার করে।’’ সেই প্রসঙ্গ টেনে এ দিন সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলছেন উনি সূচ, আর কেন্দ্রে যিনি রয়েছেন, তিনি চালুনি। সে তো হবেই। কেন্দ্রে যিনি আছেন, তিনি তো চালুনিই হবেন। তিনি দেশের সরকার চালান। তিনি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনেন। আপনি তো আর যুদ্ধবিমান কিনতে পারবেন না।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তীব্র শ্লেষে বিঁধে সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের মন্তব্য, ‘‘আসলে আপনার রাগের কারণটা হচ্ছে, আপনি সূচ হয়ে রয়েছেন, চালুনি হতে পারছেন না কেন?’’

এ দিনের সমাবেশের শেষ বক্তা ছিলেন রায়গঞ্জের সাংসদ তথা সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। মোদী এবং মমতাকে ‘হিটলারের নাতি-পুতি’ বলে আক্রমণ করেন তিনি। রাজ্য জুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রসঙ্গে তুলে আক্রমণ করেন তৃণমূলকে। দল ভাঙানোর প্রসঙ্গেও তৃণমূলকে তিনি আক্রমণ করেন। সেলিমের ভাষণে উঠে আসে দেবলীনা হেমব্রমের প্রশংসা। তিনি বলেন, ‘‘টালিগঞ্জ থেকে আমাদের নায়িকা আনতে হয় না। পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার লালমাটি থেকে লালঝান্ডা নিয়ে লড়াই করে দেবনীলা হেমব্রমরা আমাদের নায়িকা হয়ে উঠে আসেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন