গোপালকৃষ্ণে ব্যথিত, বুদ্ধ দরাজ মনমোহন-সনিয়ায়

যত দিন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন, রাজ্যপাল সম্পর্কে মন্তব্য এড়িয়ে চলেছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের উত্তাল পর্বে তাঁর দলীয় সতীর্থ বিনয় কোঙার, শ্যামল চক্রবর্তীরা রাজ্যপালকে নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন ঠিকই।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:০২
Share:

—ফাইল চিত্র

যত দিন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন, রাজ্যপাল সম্পর্কে মন্তব্য এড়িয়ে চলেছেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের উত্তাল পর্বে তাঁর দলীয় সতীর্থ বিনয় কোঙার, শ্যামল চক্রবর্তীরা রাজ্যপালকে নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পরেও এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি। শেষ পর্যন্ত নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্বের ১০ বছরের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরই প্রস্তাব মেনে দিল্লির মনমোহন সিংহের সরকার রাজভবনে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেই গোপালকৃষ্ণের ভূমিকাই পরে তাঁকে ক্ষুব্ধ, ব্যথিত করেছিল।

Advertisement

বস্তুত, বুদ্ধবাবুর জবানিতে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ সম্পর্কে মূল্যায়ন পাওয়া গেল এই প্রথম— তাঁর ‘ফিরে দেখা’র দ্বিতীয় পর্বে। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ ১০ বছরের কাজের পর্যালোচনা করে বুদ্ধবাবুর এই বই সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করেছে। এর আগে বামফ্রন্টের প্রথম পাঁচ বছরের কাজ নিয়ে তাঁর ‘ফিরে দেখা’র প্রথম পর্ব বই বিপণি থেকে উধাও হয়েছিল দ্রুত। দ্বিতীয় পর্বে বুদ্ধবাবু আরও বেশি খোলামেলা এবং আবেগময়। কারণ, শেষ ১০ বছর মহাকরণের রাশ ছিল তাঁর নিজের হাতেই।

রাজ্যপালের দায়িত্ব ছাড়ার পরে গোপালকৃষ্ণ আনন্দবাজার সংস্থারই ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দু’জনের মধ্যে বই আদানপ্রদান হতো। হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের কথা মেনে নিয়েছেন বুদ্ধবাবুও। কিন্তু একই সঙ্গে রাজভবনে সিঙ্গুরের জমি নিয়ে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা এবং ৪০০ একর ফেরত দেওয়ার দাবি নিয়ে জেদাজেদির প্রসঙ্গ এনে বুদ্ধবাবু লিখেছেন, ‘বিরোধীদের রক্ষায় তিনি হঠাৎ মাঠে নামলেন কেন? শিল্পায়নের প্রশ্নে রাজ্যের শরীরে যে বিষাক্ত ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বদ রক্তক্ষরণ যত দিন চলবে, রাজ্যের মানুষ রাজ্যপাল গাঁধীকেও তত দিন মনে রাখবে’!

Advertisement

এর আগেই অবশ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলে নিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রাজ্যপাল পদে আমার কোনও নামের প্রস্তাব আছে কি না। আমি খুশি হয়েছিলাম, সাধারণত দিল্লির সরকার এই সব সৌজন্যের ধার ধারে না। আমি শ্রী গাঁধীর নাম প্রস্তাব করেছিলাম। রাজ্যপালের দায়িত্ব নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই ছিল’।

পরে আবার নন্দীগ্রামের ঘটনা প্রসঙ্গে বুদ্ধবাবু বলেছেন, সংঘর্ষ-গুলিবর্ষণ-মৃত্যু তিনি চাননি। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলা হয়েছিল। সেই ২০০৭ সালের ১৪ মার্চের সম্পর্কে বুদ্ধবাবুর মন্তব্য, ‘ঘটনাটি যেমন দুঃখজনক, তেমনই রহস্যাবৃত। কয়েক দিন ধরে প্রচার চলল, সংঘর্ষে আরও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহগুলি নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শিশুদেরও খুন করা দেহগুলি আছে। প্রকৃতপক্ষে এ রকম কোনও ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু অনেক লেখক এই অজানা মৃতদেহগুলির জন্য দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দিলেন’। এখানেই গোপালকৃষ্ণ সম্পর্কে বুদ্ধবাবুর সংযোজন, ‘কম বিস্মিত হইনি নন্দীগ্রামের ঘটনায় রাজ্যপাল গাঁধীর ‘হাড় হিম করা’ প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ায়। তিনি জানতেন, সেখানে নির্বিচারে মানুষ খুন হচ্ছে, পুলিশ আধিকারিকও খুন হচ্ছে। মাওবাদীরা ঘাঁটি করছে। রাজ্য সরকার পুলিশ পাঠিয়েছিল আইনরক্ষার কর্তব্যপরায়ণতায়। সেই উদ্দেশ্যকে সমর্থন না করে তিনি বিপরীতে খোলা বিবৃতি দিয়ে তাঁর অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে গেলেন। কাকে খুশি করতে’?

বিরোধী থাকাকালীন রাজভবনের উপরে ভরসা করলেও সরকার চালাতে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে এখন মমতার সরকারও। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কিছু বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় মমতার সরকার যেমন তাঁকে কয়েক বার কড়া মন্তব্য করে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাক্তন রাজ্যপালের সম্পর্কে তিক্ততা কিছুটা কমেছে সিপিএমের অন্দর মহলে। তাদেরই প্রভাবিত আইনজীবী সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করানো হয়েছে সেই গোপালকৃষ্ণকে দিয়েই!

গোপালকৃষ্ণের নিয়োগকর্তা মনমোহন বা সনিয়া গাঁধী সম্পর্কে অবশ্য যথেষ্ট দরাজই পাওয়া গিয়েছে বুদ্ধবাবুকে। সনিয়ার সঙ্গে আলাপের পরে এ দেশের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতা এবং রাজনীতির বাইরে শিল্পকলায় কংগ্রেস সভানেত্রীর উৎসাহ তাঁর ভাল লেগেছিল। তিনি লিখেছেন, মনমোহনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। মনমোহনের মধ্যে তিনি কোনও দ্বিচারিতা এবং রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা দেখেননি। কাশ্মীর থেকে তেলঙ্গানা, বহু বিষয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর মত নিতেন। বুদ্ধবাবুর কথায়, ‘শেষ পর্যন্ত যখন ভারত-মার্কিন চুক্তির সূত্রে সমর্থন তুলে নেওয়া হচ্ছে— উনি সোজাসুজি আমার কাছ থেকেই বিষয়টি বুঝতে চেয়েছিলেন। বাম-কংগ্রেস সহযোগিতার সম্পর্ক ভেঙে যাক, উনি এটা চাইছিলেন না। বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কিছুই করার নেই’! কারাটদের সমর্থন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তে বুদ্ধবাবু নিজেও যে খুব প্রীত ছিলেন না, তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতও ধরা পড়েছে এই কয়েকটা লাইনে। প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগে প্রেসিডেন্সির কলেজের দু’শো বছর পূর্তিতে কলকাতায় এসে মনমোহনও বলে গিয়েছিলেন, বুদ্ধবাবুর সঙ্গে কথা বলতে তাঁর ভাল লাগতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন