ক্ষতিপূরণে কেন রাজকোষের টাকা, নবান্নকে প্রশ্ন এজি’রও

প্রশ্নটা গোড়াতেই উঠেছিল। প্রায় সতেরো মাস বাদে একই প্রশ্ন তুলে বিতর্ক উস্কে দিল খোদ সিএজি’র অফিস। তাদের পশ্চিমবঙ্গ শাখা (এজি বেঙ্গল) গত মাসে রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, সারদার আমানতকারীদের ক্ষতি পোষানোর জন্য সরকার আমজনতার করের টাকায় তহবিল গড়ল কেন? নবান্নে ওই চিঠি আসার এক মাস গড়িয়ে গিয়েছে। সরকারের তরফে কেন্দ্রীয় হিসেবরক্ষককে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। চিঠি পাওয়ার পরে সারদা-তহবিলে সরকার অবশ্য টাকাও জমা করেনি। কিন্তু এজি’র প্রশ্নের উত্তরে নবান্ন-কর্তারা এখনও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকায় সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের ‘ঘনিষ্ঠতা’র অভিযোগই দিন দিন মান্যতা পাচ্ছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের একাংশ।

Advertisement

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৭
Share:

সারদা-কাণ্ডে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলালেন রাজদেও গোয়ালা, অনাদি সাহু, সুজন চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী, নেপালদেব ভট্টাচার্য-সহ বাম নেতৃত্ব। সোমবার এস এন ব্যানার্জি রোডে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

প্রশ্নটা গোড়াতেই উঠেছিল। প্রায় সতেরো মাস বাদে একই প্রশ্ন তুলে বিতর্ক উস্কে দিল খোদ সিএজি’র অফিস। তাদের পশ্চিমবঙ্গ শাখা (এজি বেঙ্গল) গত মাসে রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, সারদার আমানতকারীদের ক্ষতি পোষানোর জন্য সরকার আমজনতার করের টাকায় তহবিল গড়ল কেন?

Advertisement

নবান্নে ওই চিঠি আসার এক মাস গড়িয়ে গিয়েছে। সরকারের তরফে কেন্দ্রীয় হিসেবরক্ষককে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। চিঠি পাওয়ার পরে সারদা-তহবিলে সরকার অবশ্য টাকাও জমা করেনি। কিন্তু এজি’র প্রশ্নের উত্তরে নবান্ন-কর্তারা এখনও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকায় সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের ‘ঘনিষ্ঠতা’র অভিযোগই দিন দিন মান্যতা পাচ্ছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের একাংশ। এই মহলের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার অবৈধ কাজ-কারবারের অভিযোগ পুরনো হলেও এর আগে কোনও সংস্থার প্রতারিত আমানতকারীদের টাকা ফেরাতে সরকার নিজে তহবিল গড়েনি। সারদার ক্ষেত্রে মমতা সরকার সেই নজির ভেঙেছে।

এবং এজি দেখেছে, এ পর্যন্ত সারদা-তহবিলের পুরোটাই জুগিয়েছে রাজ্য সরকারের দুই দফতর। “সরকারি কোষাগার থেকে তহবিলে এ যাবৎ জমা পড়া ২৬৭ কোটি টাকার ৮০ কোটি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র (প্রথমে ৫০ কোটি, পরে ৩০ কোটি), বাকিটা অর্থ দফতর। যে হেতু স্বরাষ্ট্র দফতরের দেওয়া ৫০ কোটি দিয়ে তহবিলের সূচনা, তাই তাদের কাছেই এজি কৈফিয়ত চেয়েছে।” বলেন নবান্নের এক কর্তা। তিনি জানান, এজি-র অফিস এখন বিভিন্ন দফতরের হিসেব অডিট করছে। সেই সূত্রেই সরকারি নথি ঘেঁটে তারা দেখেছে, স্বরাষ্ট্র দফতর তাদের ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষের পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাত থেকে দু’দফায় ৮০ কোটি টাকা তুলে সারদা-তহবিলে জমা করেছে। অর্থ দফতরও একই ভাবে নিজেদের বাজেটের টাকা তহবিলে ঢেলেছে। কাজেই পরবর্তী কালে অর্থ দফতরের কাছেও এজি’র অফিস একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

Advertisement

সারদা-কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পরে, গত বছরের ২৩ এপ্রিল ‘ছায়াসঙ্গিনী’ দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ধরা পড়েন কাশ্মীরে। দু’দিন বাদে, ২৫ এপ্রিল মহাকরণে ভরা সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের আমানত ফেরাতে রাজ্য সরকার পাঁচশো কোটি টাকার তহবিল গড়বে। যার দেড়শো কোটির সংস্থান হবে তামাকজাত দ্রব্যে বসানো কর থেকে। সরকারি তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে শ্যামল সেন কমিশন গঠনের কথাও ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।

বিতর্কের সূত্রপাত তখনই। বিরোধীরা প্রশ্ন তোলেন, একটি লগ্নিসংস্থার মালিকের কুকর্ম ঢাকতে সরকার কেন তহবিল গড়বে? কেনই বা ক্ষতিপূরণের নামে আমজনতার করের টাকা কিছু মানুষকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে দেওয়া হবে? অন্য বিভিন্ন লগ্নিসংস্থায় টাকা রেখে সর্বস্বান্ত লোকজনের স্বার্থে কেন এমন উদ্যোগ হল না, সে প্রশ্নও ওঠে।

এরই প্রেক্ষাপটে মাথা চাড়া দেয় সরকার-সারদা ‘গোপন আঁতাতের’ অভিযোগ। বস্তুত রাজ্য প্রশাসনেরই একাংশের অভিমত, পশ্চিমবঙ্গে পালাবদল ঘটিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর কিছু নেতা-মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতায় আড়াল বলতে কিছু ছিল না। উপরন্তু সরকারি তকমার বেশ কিছু প্রকল্প বা অনুষ্ঠানের পুরোভাগে সারদা’কে দেখা গিয়েছে। যেমন জঙ্গলমহল ও লাগোয়া অঞ্চলের জন্য যে স্বাস্থ্য-পরিষেবা প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, তা পরিচালনার ভার ছিল সারদা গোষ্ঠীর হাতে। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের পর্যটন, বিনোদন সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, এমনকী চলচ্চিত্র উৎসবে নৈশভোজের স্পনসর হিসেবেও সারদার উপস্থিতি মানুষের চোখে পড়েছে।

ফলে সারদার কাণ্ডে সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংশ্রবের অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয় বলে প্রশাসনের এই মহলের দাবি। এজি বেঙ্গল-ও প্রকারান্তরে সেই প্রশ্ন তুলেছে। নবান্নকে লেখা চিঠিতে তাদের বক্তব্য: সারদা গোষ্ঠীর কোনও সংস্থায় সরকারের অংশীদারি নেই। সুতরাং সারদায় টাকা রেখে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণের দায় সরকারের থাকার কথা নয়। “তা-ও সরকারি কোষাগার থেকে টাকা তুলে সারদা-তহবিলে দেওয়া হল কেন?” প্রশ্ন এজি’র।

এর জবাব নবান্ন এখনও দেয়নি। কেন দেয়নি?

সরকারি ভাবে প্রশাসনের কেউ মুখ খোলেননি। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সোমবার যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনও মন্তব্য করতে চাননি। যদিও প্রশাসনের এক শীর্ষ আধিকারিকের দাবি, “সরকার বহু ক্ষেত্রে জনস্বার্থে কাজ করে। সারদা তহবিলে টাকা জোগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা। সরকারের বক্তব্য যথাসময়ে এজি’কে জানিয়ে দেওয়া হবে।”

ঘটনা হল, এজি-র চিঠি পাওয়ার পরে সরকার সারদা-তহবিলে আর টাকা জমা করেনি। যার ব্যাখ্যা হিসেবে এক অর্থ-কর্তার যুক্তি: সারদা-কেলেঙ্কারির সিবিআই-তদন্ত শুরু হওয়ায় তহবিলে টাকা জমা করার তেমন চাড় সরকারের আর নেই। প্রশাসনের একাংশের কাছে আর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এই মহলের মতে, রাজকোষের অবস্থা সঙ্গিন। এমতাবস্থায় পাঁচশো কোটির তহবিলের বাকি ২৩৩ কোটি জোগাড় করা সরকারের পক্ষে বাস্তবিকই কঠিন। তার উপরে ৪৯% মহার্ঘভাতা বাকি রেখে এ ভাবে জনগণের করের টাকায় ক্ষতিপূরণের তহবিল তৈরি নিয়ে সরকারি কর্মীমহলে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এ কারণেও সারদা-তহবিলে টাকা ঢালার উৎসাহে ভাটা পড়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন