নারদ-কাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ নিজের হেফাজতেই রাখবে কলকাতা হাইকোর্ট। ম্যাথু স্যামুয়েলের কাছ থেকে ওই ভিডিও ফুটেজ কলকাতায় নিয়ে আসার জন্য আদালত তিন সদস্যের যে কমিটি তৈরি করেছে তাতে রয়েছেন সিবিআইয়ের এক কর্তাও। সোমবার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ এই নির্দেশ দিয়েছে।
হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন নারদ নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েল। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমি পুরো অসম্পাদিত ফুটেজ কমিটির হাতে তুলে দেব। যে ডিভাইস-এ এগুলি রেকর্ড করা হয়েছে, সেটিও জমা দেব। ফুটেজ যাচাই করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, ক্যামেরায় যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁরা ঘুষ নিয়েছেন, কোনও অনুদান নয়। আমি তাঁদের টাকা দিয়েছি। এগুলি বিকৃত নয়।’’
স্টিং অপারেশনে দেখানো ভিডিও কতটা খাঁটি, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টে তিনটি জনস্বার্থ মামলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই ভিডিও ২২ মার্চ আদালতে পেশ করার জন্য স্যামুয়েলকে নির্দেশ দেয় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। আদালতে আর্জি জানিয়ে স্যামুয়েল জানান, তাঁর নিজের এবং ভিডিও ফুটেজের নিরাপত্তা নিয়ে হুমকি রয়েছে। তাই তিনি আদালতে হাজির হয়ে ফুটেজ দিতে পারছেন না। দিল্লিতে এগুলি হস্তান্তরের জন্য আবেদন জানান তিনি।
গত শুক্রবার এই নিয়ে মামলার শুনানিতে আবেদনকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে ওই ফুটেজ পরীক্ষার কথা বলেন। ঘুষ-কাণ্ডে অভিযুক্তদের অন্যতম আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছে ফুটেজ গচ্ছিত রাখার ব্যাপারে আপত্তি জানান। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রও এর বিরোধিতা করেন। সে দিনই প্রধান বিচারপতি জানিয়েছিলেন, এ নিয়ে সোমবার নির্দেশ দেবেন তিনি।
এ দিন শুরুতেই সেই নির্দেশ দিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করে ডিভিশন বেঞ্চ। কমিটিতে আছেন রাজ্য পুলিশের এক আইজি, হাইকোর্টের এক রেজিস্ট্রার এবং সিবিআইয়ের পূর্বাঞ্চলের এক ডিআইজি। ভিডিও এবং যন্ত্র দিল্লি থেকে এনে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের হেফাজতে দেবে এই কমিটি। আজ, মঙ্গলবার কমিটির তিন সদস্যের নাম ঠিক হবে। কমিটি গঠন করার আগে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, ভিডিও ফুটেজ সঠিক বলে প্রমাণিত হলে সমাজে তার গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে। সে কথা ভেবেই আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই ফুটেজ এবং যে যন্ত্রে ভিডিওগ্রাফি করা হয়েছে, তা নিরাপদ জায়গায় রাখা জরুরি। তবে কবে ওই কমিটি ম্যাথুর কাছে যাবে, কোথা থেকে ফুটেজ ও যন্ত্র সংগ্রহ করবে— ডিভিশন বেঞ্চ তা গোপন রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, ফুটেজ ও যন্ত্র গ্রহণ করার পুরো পর্ব ভিডিওগ্রাফি করতে হবে। ওই কমিটির যাতায়াত-সহ যাবতীয় খরচ বহন করবেন জনস্বার্থ মামলার আবেদনকারীরা।
নারদের স্টিং অপারেশনে শাসক তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের টাকা নেওয়ার ছবি সামনে আসতেই ভোটের রাজ্যে তোলপাড় পড়েছে। বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণের মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বলেন, ‘‘ভিডিওটা ভেজাল!’’ পরে সুর বদলে বলেন, ‘‘যদি কেউ টাকা দিয়েছে, সে-ও অন্যায় করেছে।’’ আদালতে কল্যাণ বলেন, ‘‘ডোনেশন (অনুদান) আর ব্রাইব (ঘুষ)-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।’’ তার পরেও ঘরে-বাইরে সমালোচনা আর অস্বস্তি কাটছে না বুঝে গত শনিবার সেই মমতার নির্দেশেই দলের অন্দরে তদন্তের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেও।
এ দিন স্যামুয়েলকে প্রশ্ন করা হয়, ঘুষ দেওয়ার জন্য তো আপনার বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে? তাঁর জবাব, ‘‘আমার সত্যি করে কোনও কোম্পানি নেই। একটি ভুয়ো কোম্পানি তৈরি করে গিয়েছিলাম। আমি তো কোনও সুবিধা নিইনি।’’
তৃণমূল তো একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি তৈরি করেছে? স্যামুয়েলের জবাব, ‘‘এই তদন্ত কমিটির কোনও মূল্য নেই। নিজেরাই নিজেদের ক্লিনচিট দেবে! তৃণমূল যদি সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ কর্তা মির্জা আর দলের পক্ষ থেকে ইকবালকে কমিটিতে রাখে, তা হলে তাঁরাই সব বলে দেবেন। কে কত টাকা নিয়েছেন, তাঁরা জানেন।’’ আদালতের নির্দেশ জানার পরে বীরভূমে ভোট প্রচারে গিয়ে তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘‘সব রকমের তদন্ত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। শুধু তা-ই নয়, তদন্ত করলে প্রকৃত ব্যাপারটা উঠে আসবে। যা আমার দলও করছে।’’