কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য শান্তা দত্ত দে। — নিজস্ব চিত্র।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলিতে নির্বিঘ্নেই মিটেছে সেমেস্টারের পরীক্ষা। এমনটাই জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য শান্তা দত্ত দে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস ২৮ অগস্ট। সেই দিন পরীক্ষা হওয়া নিয়ে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল, প্রথম থেকেই তা নিয়ে অনড় ছিলেন উপাচার্য। প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, পরীক্ষা নির্ধারিত দিনে হবে। বৃহস্পতিবার সেই পরীক্ষা মিটে যাওয়ার পরে শান্তা জানালেন, মুখ্যমন্ত্রীর নাম করেও তাঁকে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক তাঁকে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন, পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। শান্তা জানিয়েছেন, বিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারকে সামনে রেখেই তিনি পরীক্ষা পরিচালনা করিয়েছেন। প্রথমার্ধে ৯৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয়ার্ধে ৯৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছেন। বহু কলেজের অধ্যক্ষেরাও জানিয়েছেন, যতটা আশঙ্কা করেছিলেন, পরীক্ষা পরিচালনা নিয়ে ততটা সমস্যা তৈরি হয়নি।
বৃহস্পতিবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে মেয়ো রোডে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। একই দিনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ এলএলবি এবং বিকম চতুর্থ সেমেস্টারের পরীক্ষা ছিল। অধ্যক্ষ, অধ্যাপকদের একাংশের আশঙ্কা ছিল, পরীক্ষা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন ছাত্রছাত্রীরা। তাঁরা এই নিয়ে অস্থায়ী উপাচার্যের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। সেই পরীক্ষা মিটে যাওয়ার পরে শান্তা বলেন, ‘‘পরীক্ষা কী ভাবে হবে, চিন্তা হচ্ছিল অনেকের। কিন্তু আমি জানতাম, ভাল ভাবে পরীক্ষা হবে। ৩০,০০০ পড়ুয়ার মধ্যে খুব কম শতাংশ জানিয়েছিলেন, তাঁরা আজ পরীক্ষা চান না। অভিভাবকেরাও পরীক্ষা হোক চেয়েছিলেন।’’
‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ’
শান্তা জানান, এই পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ এসেছিল বিভিন্ন ভাবে। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিন রাতে হঠাৎ ২৫ জন ছাত্র এসে বাগ্বিতণ্ডা শুরু করেন। তাঁদের দাবি, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবসে যে পরীক্ষা রয়েছে, তার দিন পরিবর্তন করতে হবে। তাঁদের কর্মসূচিতে সমস্যা হবে। তাঁরা ছাত্র কি না, যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমি জানাই, পিছু হঠতে পারব না। কারণ, অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও একই দাবি করবে। তখন তাঁরা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করেছেন।’’ শান্তা জানিয়েছেন, এর পরে উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে পরীক্ষার দিন পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে উচ্চশিক্ষা দফতরের আধিকারিকের ফোন আসে। আমাকে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন তিনি। আমি তখন বলি, সেটা সম্ভব নয়। তখন ওই আধিকারিক আমাকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। তখন বুঝিয়ে বলি, এটা করা যাবে না। আজ যদি আমরা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জন্য করি, অন্য রাজনৈতিক দলগুলি বাদ যাবে কেন?’’ শান্তা জানিয়েছেন, চিঠি পাওয়ার পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংগঠন ‘সিন্ডিকেট’-এর বৈঠক ডাকেন। শান্তা বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট বৈঠকে ওমপ্রকাশ মিশ্র সব থেকে বেশি বলেন, যে এটা (পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া) মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ। এবং সরকারের অন্যান্য আধিকারিক যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও একই কথা বলেন।’’ প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে রাজ্য সরকারের সদস্য ওমপ্রকাশ।
স্বতন্ত্র
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য শান্তা জানিয়েছেন, পরীক্ষা করানো নিয়ে ভোটাভুটি হয়। তাতে বেশির ভাগই পরীক্ষা করানোর বিষয়ে মত দেন। শান্তার অভিযোগ, বাইরের ছাত্র, যাঁরা পাশ করে বেরিয়ে গিয়েছেন, সেই পড়ুয়ারা হুমকি দেন, কটূক্তি করেন। মানসিক চাপ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র খারাপ ভাষায় কথা বলেন। শান্তার কথায়, ‘‘ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।’’ এর পরেই শান্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রতার কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোনমি (স্বতন্ত্র) থাকবে না! শিক্ষার বিষয় বিধি মেনেই চলার কথা। অটোনমি যে ভাবে রাখা দরকার, করেছি। আমার সিন্ডিকেট সদস্যদের কৃতিত্ব দিতে চাই।’’
উপস্থিতি
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক জয়ন্ত সিংহ জানান, বৃহস্পতিবার দুই অর্ধে পরীক্ষা হয়েছে। প্রথমার্ধে ৯৬ শতাংশ উপস্থিতি ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে উপস্থিতি ছিল ৯৫ শতাংশ। মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০,০০০। ৬৭টি পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল। ১১ টি আইন কলেজ এবং ১০টি বিএ, বিএসসি, বিকম, ১টি এলএলবি কলেজে পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষাটা নেওয়ার বিষয়ে অনেক সহযোগিতা মিলেছে। এখনও কিছু অভিযোগ জমা পড়েনি। রেজিস্ট্রার দেবাশিস দাস বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট নির্দেশ দিয়েছিল। আমি উচ্চশিক্ষা দফতরে চিঠি দিই। কলকাতা পুলিশ ঠিক ভাবে কাজ করেছে।’’
অধ্যক্ষদের দাবি
শান্তার সঙ্গে একমত হয়েছেন বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষেরাও। তাঁরা জানিয়েছেন, পরীক্ষা মোটামুটি নির্বিঘ্নেই মিটেছে। এজেসি বোস কলেজের কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথমার্ধে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৯১ জন। তাঁদের মধ্যে ছ’জন পরীক্ষাহলে অনুপস্থিত ছিলেন। অধ্যক্ষ সমীরণ মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রথমার্ধের পরীক্ষা নির্বিঘ্নে হয়েছে। তবে সকালের দিকে পড়ুয়া, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের কলেজে পৌঁছোতে বেগ পেতে হয়েছে।’’
সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজের অধ্যক্ষ জাফর আলি আখান জানান, প্রথম ধাপে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬০০। দ্বিতীয় ধাপে সেই সংখ্যা ছিল তিনশোর কিছু বেশি। প্রথমার্ধে কয়েক জন অনুপস্থিত ছিলেন। অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে নির্ধারিত সময়ের পরে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট খোলা ছিল গেট। তাঁর কথায়, ‘‘যা আশঙ্কা করেছিলাম, তার তুলনায় অনেক ভাল ভাবে পরীক্ষা হয়েছে।’’ কুমোরটুলি থেকে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন কৃতিকা পাল। তিনি বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম বৃহস্পতিবার সমস্যায় পড়ব। কিন্তু কোনও অসুবিধা হয়নি। সহজেই পৌঁছে গিয়েছি কলেজে।’’
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাতিল
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হলেও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি বিষয়ের পরীক্ষা বৃহস্পতিবার বাতিল করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বাতিলের কারণ জানিয়েছেন, ‘অনিবার্য’। বাংলা ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট, এই দু’টি পত্রের মৌখিক পরীক্ষা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু ২৭ অগস্ট, বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নোটিস দিয়ে তা বাতিল করার কথা জানান। যদিও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আইন বিভাগে পরীক্ষা হয়েছে। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার ছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস। সে জন্যই পরীক্ষা বাতিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরীক্ষা বাতিল হয়েছে বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়েও। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শঙ্করকুমার নাথ বলেন, ‘‘আমাদের পড়ুয়ারা সকলে বহু দূর থেকে আসে। তাদের অনেককে হয় ৩-৪ টে বাস পরিবর্তন করে আসতে হয়। আর আজ যাতায়াতে খুব অসুবিধা হত। আজ ওরা যদি না আসতে পারে, পরীক্ষা তো আবার করাতেই হবে। সেজন্য ওরাই আবদার করেছিল যে, ওদের আজ যদি পরীক্ষা না দিতে হয়, তা হলে খুব ভাল হয়। সে জন্য আমরা স্থগিত করেছি।’’ আইন বিভাগে পরীক্ষা হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ওটা ইন্টারনাল পরীক্ষা, ওটা ওরা নিজেরা করছে। ওই বিভাগে বেশি ছাত্রও থাকে না। অতএব এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে সমস্যা তৈরি করবে না। বেশির ভাগই স্থানীয় পড়ুয়া। তাই কোনও অসুবিধা নেই।’’
বিতর্কের সূত্রপাত
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন অধ্যক্ষ, অধ্যাপকদের একাংশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য শান্তাকে সোমবার চিঠি দেয় তৃণমূল সমর্থিত অধ্যাপকদের সংগঠন ওয়েবকুপা। সোমবারের পর ফের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন জানিয়ে মঙ্গলবার শান্তাকে চিঠি দেয় নিখিল বঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদ। তাদের দাবি, ২৮ অগস্ট পরীক্ষা হলে ছাত্রছাত্রীরা অসুবিধায় পড়বে। তাদের কথায়, ‘‘সে দিন যে সকল ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে আসবেন, তাঁরা যদি সময় মতো পরীক্ষা হলে পৌঁছোতে না পারেন, তা হলে কী হবে! অধ্যক্ষদের বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছেন উপাচার্য।’’ ১ অগস্ট ওই পরীক্ষার দিন পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছিল উচ্চশিক্ষা দফতর। সে চিঠিতে জানানো হয়েছিল, ২৮ অগস্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ বিষয়ের পরীক্ষা রয়েছে। কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় মিছিল এবং সভার জন্য পরীক্ষার্থীদের অসুবিধা হতে পারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য যদিও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, পরীক্ষা হবে নির্ধারিত দিনেই। তিনি বলেন, ‘‘যে দাবি তোলা হচ্ছে, তা অনৈতিক। পড়ুয়াদের একাংশ যে কথা বলছে, অধ্যক্ষদের একাংশও সেই সুরে বার্তা দিচ্ছেন। যা অনভিপ্রেত।’’
শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলিতে ‘নির্বিঘ্নেই’ মিটেছে বৃহস্পতিবারের পরীক্ষা।