উদ্যোগী পর্যটন

ঝালচচ্চড়ির সুদিন ফিরুক বাংলার লজে

বাইরে ঝিরঝিরে ইলশেগুঁড়ি। পিচ রাস্তার ও-পারে নদী উথাল-পাথাল। ‘সাগরিকা’র দোতলায় রেস্তোরাঁর টেবিলে টেবিলেও মানানসই অর্ডারের তুফান। ইলিশ ভাজা, ইলিশ ভাপা।সঙ্গে অনুপান?কারও আব্দার— মুগের ডাল, ঝুরো আলু ভাজা। এক জন ইলিশ খান না।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০৩:২২
Share:

বাইরে ঝিরঝিরে ইলশেগুঁড়ি। পিচ রাস্তার ও-পারে নদী উথাল-পাথাল। ‘সাগরিকা’র দোতলায় রেস্তোরাঁর টেবিলে টেবিলেও মানানসই অর্ডারের তুফান। ইলিশ ভাজা, ইলিশ ভাপা।

Advertisement

সঙ্গে অনুপান?

কারও আব্দার— মুগের ডাল, ঝুরো আলু ভাজা। এক জন ইলিশ খান না। অসুবিধে নেই। টাটকা ভেটকির ফ্রাই আছে। আলু দিয়ে রাঁধা মুরগির লাল ঝোলের সঙ্গে এক প্লেট ভাত চোখের নিমেষে সাফ।

Advertisement

ডায়মন্ড হারবারের মেছো তল্লাটে যদি রসনাপূর্তির এমন বন্দোবস্ত, তা হলে বোলপুরে শান্তিনিকেতন ট্যুরিস্ট লজ কিংবা মেদিনীপুরের শিরোমণি লজে পোস্তর বড়া, আলুপোস্ত, পাকা পোনার ঝোলের স্নিগ্ধ, সরল আয়োজন। আনুষঙ্গিক হিসেবে মরসুমি সব্জিতে আলু মিশিয়ে মনকাড়া ডালনা। শেষ পাতে চাটনি। কুলিক পক্ষীনিবাসের মধ্যে, রায়গঞ্জ ট্যুরিস্ট লজে আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল কলকাতার দুই সাংবাদিকের জন্য। সরকারি অতিথিনিবাসটিতে সে দিন দুপুরের মেনু মৌরলার ঝালচচ্চড়ি আর সর্ষেবাটা দিয়ে পাবদা। পাশে সাজানো টক দইয়ের বাটি!

তবে এ সব কার্যত অতীত। রাজ্যের অধিকাংশ ট্যুরিস্ট লজে বর্তমানের ছবিটা হল:

— ‘কী হবে ভাই?’

— ‘এই তো স্যার, নিরামিষে ডাল ফ্রাই, আলু ফ্রাই, মিক্সড ভেজ, মটর পনির, পনির বাটার মসালা, আলু গোবি। নন ভেজে পাবেন চিকেন কারি, চিকেন মসালা, চিকেন বাটার মসালা, রুই কারি, রুই মশলা।’ চাইনিজও হাজির। ফ্রায়েড রাইস, চাউমিন থেকে চিলি চিকেন, মাঞ্চুরিয়ন চিকেন, গার্লিক চিকেন— সব আইটেমই যে তাঁদের হেঁসেলে মজুত, রেস্তোরাঁ-কর্মী তা সগর্বে জানিয়ে রাখেন।

জানতে দেরি হয় না, বাংলার অধিকাংশ সরকারি ট্যুরিস্ট লজ মেনু থেকে বাঙালিয়ানাটাই বিসর্জন দিয়ে বসেছে, যা এত দিন তাদের অন্যতম ‘ইউএসপি’ হিসেবে গণ্য হতো।

এ বার সেই হারানো গরিমা ফিরিয়ে আনতে কোমর বাঁধছেন রাজ্যের নতুন পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর কথায়, ‘‘আগে ট্যুরিস্ট লজগুলোর আকর্ষণের বড় কারণ ছিল যত্ন সহকারে পরিবেশন করা ঘরোয়া বাঙালি খাবার। সেটা ফেরাতে হবে। আমরা কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছি।’’ কী রকম?

পর্যটন দফতর সূত্রে খবর, ২৯টি ট্যুরিস্ট লজে রাঁধুনির মোট পদের অন্তত ৪০% ফাঁকা। তাড়াতাড়ি সেগুলোয় লোক নেওয়া হবে। চিরায়ত বাঙালির রান্নায় পটু যাঁরা, কিংবা দ্রুত শিখে নিতে আগ্রহী, তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। ‘‘নিশ্চিত করতে হবে, ঘরোয়া বাঙালি খাবারের স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ যেন ট্যুরিস্ট লজে পাওয়া যায়।’’— বলছেন গৌতমবাবু।

হাতে গোনা কয়েকটা লজ অবশ্য এখনও ঐতিহ্য কিছুটা ধরে রেখেছে। যেমন বহরমপুর। কৃষিবিজ্ঞানী ও ভোজনরসিক প্রদীপ সেনকে কাজের সূত্রে গিয়ে কখনও যদি হোটেল-গেস্টহাউসে থাকতেও হয়, পেটপুজোটা কিন্তু লজেই সারার চেষ্টা করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘স্বাদ তো আছেই। মনে হয়, বাড়ির খাবারই পরিপাটি করে সামনে বেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ একই টানে রায়গঞ্জে দামি হোটেলে ডেরা বেঁধেও রাতে-দুপুরে ট্যুরিস্ট
লজে খেতে ছোটেন কেউ কেউ।

অন্য দিকে দফতরের অনেকেও স্বীকার করছেন, ডায়মন্ড হারবারের সাগরিকার পাশাপাশি মালবাজার, শিলিগুড়ির মৈনাক, মেদিনীপুরের শিরোমণি, জলদাপাড়া, কালিম্পংয়ের মর্গ্যান হাউস বা শান্তিনিকেতনের মতো বহু ট্যুরিস্ট লজের মান পড়েছে। ‘‘মালবাজার লজে ওঠা ট্যুরিস্ট উল্টো দিকের পাইস হোটেলে গিয়ে পাত পাড়ছেন, এমনটা আগে ভাবা যেত না। এখন যাচ্ছে,’’ আক্ষেপ এক কর্তার। এ জন্য দক্ষ রাঁধুনির অভাবের দিকে আঙুল তুলছেন তাঁরা। আশ্বাস দিচ্ছেন, এ বার রাঁধুনি নিয়োগের সময়ে ব্যাপারটা মাথায় রাখা হবে।

মেনুতে বাঙালিআনা ফিরিয়ে পর্যটকদের রসনাতৃপ্তি করা গেলে ব্যবসাতেও জোয়ার আসবে বলে দফতর আশাবাদী। ২৯টি ট্যুরিস্ট লজে ‘লজিং-ফুডিং’ বাবদ গত অর্থবর্ষে পর্যটন উন্নয়ন নিগমের মোট মুনাফা সাকুল্যে ৪ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা। ২০১৪-১৫য় আরও কম— মাত্র দেড় কোটি। ‘‘উনত্রিশটা লজ যেখানে আমাদের হাতে, সেখানে লাভের অঙ্ক দশ কোটিতে নিয়ে যেতে হবে।’’— মন্তব্য মন্ত্রীর।

বস্তুত খাবারের মান ফেরাতে পারলে রেস্তোরাঁ থেকে আয় বহু গুণ বাড়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনা দেখছেন দফতরের মাথারাও। তাঁদের মতে, কন্টিনেন্টাল হোক বা চাইনিজ, কিংবা বাঙালির একেবারে ঘরোয়া রান্না— স্বাদ ঠিক না-থাকলে বিলাসী মানুষ লজমুখো হওয়ার আগে দু’বার ভাববেন। এই ছবিটা বদলানো একান্ত জরুরি। তবে এ কাজে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন?

দফতর-সূত্রের খবর: পাচকের নৈপুণ্য বা খাবারের স্বাদ ছাড়াও রান্নার উপকরণ সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ। রবীন্দ্রতীর্থ ভ্রমণে শান্তিনিকেতনে আসা এক বাংলাদেশি পরিবারের অভিজ্ঞতা ধরা যাক। সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে নোনতামুখ করতে ফিশ ফিঙ্গার চেয়েছিলেন তিন প্লেট। মুখে তুললেও খেতে পারেননি, পুরনো মাছের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছে।

জলদাপাড়া ফেরত অনেকের অভিযোগ, লজের ‘কুকিং মিডিয়াম’ বা রান্নার তেলই শরীর বিগড়ে দিয়ে বেড়ানোর বারোটা বাজিয়েছে। আবার মেদিনীপুরের ‘শিরোমণি’তে ব্রেকফাস্ট চেয়ে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার অনুযোগ শোনা গিয়েছে অনেকের মুখে।

একটা সময় কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে বহু রসিক ‘সাগরিকা’য় যেতেন শুধু লাঞ্চ সারতে। এখন তাঁরাই বলছেন, অখাদ্য! ফের ওঁদের তৃপ্ত করে বাংলার লজের সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনা যাবে কি?

পর্যটন দফতরের সামনে এটাই আপাতত বড় চ্যালেঞ্জ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন