সেলফি-বিপদে এগিয়ে দেশ, কেন্দ্রের সতর্ক বার্তা রাজ্যকে

সন্ধ্যা ছ’টায় ভিড়ে ঠাসা গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে বাসের ধাক্কা খেয়েছিলেন এক যুবক। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে খাদের ধারে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে প্রাণটাই যেতে বসেছিল বর্ধমানের এক দম্পতির।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৬ ০০:৫২
Share:

সন্ধ্যা ছ’টায় ভিড়ে ঠাসা গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে বাসের ধাক্কা খেয়েছিলেন এক যুবক। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে খাদের ধারে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে প্রাণটাই যেতে বসেছিল বর্ধমানের এক দম্পতির। আবার পরীক্ষার হলে বসে ব্যাগে লুকিয়ে রাখা মোবাইল বার করে চিন্তিত মুখে উত্তর লেখার ভঙ্গিতে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে স্কুল থেকে সাসপেন্ড হয়েছিল এক কিশোর।

Advertisement

সেল্‌ফি ঘিরে এমন অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতি দিন। বিপদের পরোয়া না করে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুও হচ্ছে অনেকের। পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে বসায় এ বার এ নিয়ে নড়েচড়ে বসল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের তরফে তাই সেল্‌ফি-বিপদ সম্পর্কে প্রত্যেকটি রাজ্যকে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারি সমীক্ষাই জানাচ্ছে, গোটা পৃথিবীতে ২০১৫ সালে সেল্‌ফি সংক্রান্ত যত মৃত্যু ঘটেছিল, তার অর্ধেকই ভারতে। ২৭ জনের মধ্যে ১৪ জন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মনোরোগ চিকিৎসকদের চেম্বারেও এখন সেল্‌ফি ম্যানিয়াকদের ভিড়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট খুললেও সেল্‌ফিরই ছড়াছড়ি। ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত থেকে শুরু করে প্রিয়জনের মৃতদেহের পাশে বসে থাকা— তা সে যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, সেল্‌ফি তোলা কিন্তু বাদ নেই। স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যেও এই আসক্তি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বিভিন্ন স্কুল এ নিয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানও করছে। সম্প্রতি দিল্লিতে এ বিষয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়। যাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অবিলম্বে প্রত্যেকটি রাজ্যকে সেল্‌ফি-বিপদ এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হবে। বৈঠকে এ কাজের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের উপরেই।

Advertisement

স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের মতে, ‘সেল্‌ফি’ তোলাকে ঘিরে এমন উন্মত্ত আচরণ আদতে এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। এ ব্যাপারে রাজ্যগুলি এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন মারফত দেশ জুড়ে চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল করা হচ্ছে। যে কোনও রোগীকে সামান্য সুযোগেই কী ভাবে তাঁরা এ নিয়ে সতর্ক করতে পারেন, সে ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছে আইএমএ। সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল কৃষ্ণকুমার অগ্রবাল বলেন, ‘‘সেল্‌ফির বিকার কী ভাবে জীবনে নানা সমস্যা ডেকে আনতে পারে, অন্য কেউ তা বোঝাতে চাইলে সাধারণ মানুষ তেমন গুরুত্ব দেন না। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শের অন্য গুরুত্ব রয়েছে। তাই আমরা সব চিকিৎসককেই বিষয়টি মাথায় রাখতে বলছি। সামান্য সুযোগেই এ নিয়ে যে কোনও রোগীকে সতর্ক করার দায়িত্ব অনেকাংশেই তাঁদের।’’

এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারাও জানিয়েছেন, সেল্‌ফি নিয়ে এ বার সচেতনতা বাড়ানোর কাজ শুরু করবেন তাঁরাও। প্রয়োজনে পোস্টার ছাপানো হবে। টিভি ও রেডিওর মাধ্যমেও প্রচারের কথা ভাবা হচ্ছে। দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘কানে মোবাইল নিয়ে পথ চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শেষ নেই। বার বার সে সম্পর্কে সতর্ক করেও ফল হয়নি। এখন সেই সব দুর্ঘটনাকে প্রায় সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে মোবাইলে সেল্‌ফি তোলার প্রবণতা। রাস্তার মােঝ, খাদের ধারে, ঝর্নার কোলে, রেল লাইনে এমন কী মত্ত হাতির সামনে বিশেষ ‘পোজ’-এ সেল্‌ফি তুলতে গিয়েও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে।’’

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক বিশেষ সচিব বলেন, ‘‘মুম্বইয়ের বেশ কিছু এলাকাকে ‘নো সেল্‌ফি জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে সেল্‌ফি তুলতে গিয়ে ধরা পড়লে জরিমানা দিতে হয়। অন্য রাজ্যগুলিতেও এমন ব্যবস্থা চালু হওয়া জরুরি। আমরা সমস্ত রাজ্যকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার কথা বলছি।’’

এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত আইনমাফিক কোনও ‘নো সেল্‌ফি জোন’ নেই। তবে ছবি তুলতে গিয়ে অতি উৎসাহের জেরে যাতে বিপদে পড়তে না হয়, সে জন্য বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু জায়গায় সতর্কবাণী টাঙানো রয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সেই সতর্কবাণীকে পাত্তা দেন না প্রায় কেউই। গত বছর দুর্গা পুজোর সময়ে ঢাকুরিয়ার একটি পুজো মণ্ডপে সেল্‌ফি তোলার হিড়িকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। বেগতিক বুঝে মণ্ডপে বড় বড় করে ‘নো সেল্‌ফি জোন’ কথাটা লিখে দেওয়া হয়েছিল। ওই কথা মানতে সমস্ত দর্শনার্থীকে কার্যত বাধ্য করার দায়িত্ব ছিল মণ্ডপে মোতায়েন বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের।

কলকাতা পুলিশের কর্তারা জানিয়েছেন, যে ভাবে হেলমেট নিয়ে প্রচার চলে, বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ করার জন্য প্রচার চলে, ঠিক সে ভাবেই সেল্‌ফি নিয়ে বাড়াবাড়ি বন্ধ করতেও প্রচার করা যেতে পারে। রাস্তায় ধারে এ ব্যাপারে ছড়ার আদলে সতর্কবাণী লেখা থাকলে অনেকেরই তা চোখে পড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন