রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন ফাইল জনসমক্ষে এনে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে চাপ বাড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত কাল ফাইল প্রকাশ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘নেতাজির কী হয়েছিল, জানার পথে আমরা একটা সূচনা করে দিলাম। কেন্দ্রেরও উচিত সব জানিয়ে দেওয়া।’’ এর ২৪ ঘণ্টা পরে কেন্দ্রের প্রতিক্রিয়া থেকে এটা স্পষ্ট যে, তারা সাবধানে পা ফেলারই পক্ষপাতী। অন্য দিকে, নিজেদের আমলে নেতাজি-ফাইল প্রকাশ করতে না-চাওয়া কংগ্রেস এখন সব তথ্য সামনে আনার দাবিতে সরব হয়েছে।
সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু আজ হায়দরাবাদে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছু গোপন ফাইল প্রকাশ করেছে। ভাল কথা... (তবে) কেন্দ্র এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেখতে হবে, ওই সব ফাইলে কী রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার কী প্রভাব পড়বে, অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়বে, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।’’ এই সব দিক বিবেচনা করে তবেই সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন বেঙ্কাইয়া।
নেতাজি সংক্রান্ত গোপন ফাইল প্রকাশের দাবি ঠেকিয়ে রাখতে ইউপিএ সরকারের যুক্তি ছিল, এই সব গোপন তথ্য প্রকাশিত হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে। ২০০৬-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তথ্যের অধিকার আইনে একটি প্রশ্নের জবাবে এ-ও দাবি করেছিল, ওই সব ফাইলে এতটাই স্পর্শকাতর তথ্য রয়েছে যে তা প্রকাশ্যে এলে পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারে। কী কী ফাইল রয়েছে, তার নাম জানাতেও অস্বীকার করা হয়। আর বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছিল, নেতাজির বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে চিঠিপত্র আদানপ্রদান সংক্রান্ত ফাইলও রয়েছে। কিন্তু তা প্রকাশ করা যাবে না।
সেই সময় ফাইলগুলি প্রকাশের দাবিতে সরব ছিল বিজেপি। ইউপিএ-সরকারের দশ বছরে তারা সংসদের ভেতরে-বাইরে বারবার ওই দাবি জানিয়েছে। লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি এই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল যে, ক্ষমতায় এলে এই সব ফাইল প্রকাশ করে দেওয়া হবে। যদিও গত প্রায় দেড় বছর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর পূর্বসূরির অবস্থান আঁকড়ে ধরেই চলেছেন।
কিন্তু সব অঙ্ক ওলোটপালট করে দিয়েছেন মমতা। বিধানসভা ভোটের মুখে নেতাজি-ফাইল প্রকাশ করে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিজেপির দিকে। আর যথাসম্ভব সাবধানেই মমতার গুগলি মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন বেঙ্কাইয়া। কেন্দ্র সব দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানানোর পাশাপাশি কোনও রকম বিপরীত বার্তা যাওয়া ঠেকাতে বলেছেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, নেতাজির বিষয়ে আসল তথ্য জানার অধিকার দেশের মানুষের রয়েছে।’’
ফাইল প্রকাশের সিদ্ধান্তে বিপাকে কংগ্রেসও। কেননা, ওই সব ফাইলে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় নেতাজির পরিবারের উপরে নজরদারি চালানো হতো। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নেতাজি সংক্রান্ত যে দু’টি ফাইল প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানেও উঠে এসেছে এই তথ্য। এর পিছনে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা থাক বা না-থাক, কেন্দ্র ও রাজ্যে তখন কংগ্রেসেরই সরকার। ফলে এর দায় স্বাভাবিক ভাবেই তাদের উপর বর্তায়। অস্বস্তি এড়াতে এ বার সব ফাইল প্রকাশ করার দাবি তুলেছে কংগ্রেস। মোদী সরকারের তরফে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে এআইসিসি-র মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সূরযেওয়ালা আজ বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পরে নেহরু প্রধানমন্ত্রী হন, বল্লভভাই পটেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। যাঁরা সুভাষচন্দ্র বসুর বন্ধু ছিলেন, একসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। তাঁরাই নেতাজির পরিবারের উপর নজরদারি চালাবেন, এমনটা অসম্ভব। এই অভিযোগ মিথ্যে। কেন্দ্রীয় সরকার যাবতীয় ফাইল প্রকাশ করুক। তা হলেই আসল তথ্য সামনে আসবে।’’