পাশে: পুরুলিয়ার শিমুলিয়ার সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুজিত মাহাতো
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরুলিয়া জেলা সফরের আগেই কুড়মালি ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিধানসভা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যখন আজ, মঙ্গলবার জেলায় উন্নয়নের বৈঠক করবেন, সেই সময়েই পুরুলিয়া শহরে ফের আদিবাসী কুড়মি সমাজ আন্দোলনে নামতে চলেছে। বিষয়টি যে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভাল ভাবে নিচ্ছেন না, সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর শিমুলিয়ার প্রশাসনিক জনসভায় স্পষ্ট হয়ে গেল।
জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো মঞ্চে দাবি করেন, ‘‘আমাদের মুখ্যমন্ত্রী প্রান্তিক জেলার উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছেন। কুড়মি উন্নয়ন পর্যদ গঠন করেছেন। কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারপরেও কিছু মানুষ লোকজনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে চাই, আপনি এগিয়ে চলুন। গোটা পুরুলিয়া আপনার সঙ্গে রয়েছে।’’ তখন মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী।
এরপরেই মমতা বক্তব্য রাখতে ওঠেন। কুড়মালির প্রসঙ্গ তুলেই তিনি বলেন, ‘‘কুড়মি সম্প্রদায় যাতে এসটি স্ট্যাটাস পায়, সে জন্য আমাদের সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে লিখেছে। আমি কিছুক্ষণ আগে শুনছিলাম, শান্তি বলছিল, কেউ কেউ নাকি নানা রকম রটনার চেষ্টা করছে। যারা কোনও কাজ করে না, তারা রটনা ছাড়া আর কী করবে? কিছু না করে যদি কেউ টাকা তুলে বিবৃতি দেয়, সেটাই তো তার কাজ। আমাদের কাজ মানুষের কাজ করা। আমি কন্যাশ্রীদের কাজ করি, সবুজসাথীদের কাজ করি। এক মাত্র বাংলায় কৃষকদের জমিতে কোনও খাজনা লাগে না।’’
এই সব বলে রাজ্যের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য সরকার কী কা কাজ করছে, সেই তালিকা তুলে ধরেন। এই জেলাতেও কী কী করেছেন, তাও জানান।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘কুড়মি বোর্ড করা হয়েছে। কুড়মালি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অলচিকি হরফকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সিংভূম অ্যাকাডেমি তৈরি করা হয়েছে।’’
বস্তুত, কুড়মিদের তফসিলি উপজাতির তালিকাভুক্ত করা ও কুড়মালিকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে এই জেলায়। বন্ধ-অবরোধের পথে গিয়েছে আদিবাসী কুড়মি সমাজ। কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতো বিধানসভায় সোচ্চার হয়েছেন। শান্তিরামবাবু-সহ তৃণমূল নেতৃত্বও সরকারের ভিতরে দাবি তুলেছেন বারবার।
প্রথমে কুড়মি উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করা হয়। তারপরেই ঠিক পঞ্চায়েত ভোটের মুখেই কুড়মালিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই জেলার একটা বড় অংশের মানুষ কুড়মি সম্প্রদায়ের। এমনকী তৃণমূল নেতাদেরও একটা অংশ ওই সম্প্রদায়ের।
অন্যতম বিরোধী নেতা কংগ্রেসের নেপাল মাহাতোও কুড়মি। তাই ভোটের আগে ওই স্বীকৃতিতে স্বস্তি পেয়েছিলেন শাসকদলের জেলা নেতৃত্বও।
কিন্তু আদিবাসী কুড়মি সমাজ থেমে নেই। এ বার কুড়মিদের তফসিলি উপজাতি ভুক্ত করার দাবিতে মঙ্গলবার থেকে পুরুলিয়া শহরেই জেলাশাসকের দফতরে অবস্থান বিক্ষোভে বসতে চলেছেন তাঁরা। তাঁরা অবশ্য আগেই এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই সময়েই মুখ্যমন্ত্রীর জেলা পুলিশ লাইনের ভিতরে প্রশাসনিক বৈঠক করার কথা। তাই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার স্বার্থে আদিবাসী কুড়মি সমাজকে তাঁদের কর্মসূচি পিছোতে অনুরোধ করেছিল জেলা প্রশাসন। কিন্তু সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা রাজি হননি।
তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, কুড়মি সমাজ তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামার কথা ঘোষণা করলেও, তা রাজ্যের এক্তিয়ারে নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। রাজ্য ইতিমধ্যে তাঁদের দাবি কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করেছে। তারপরেও ফের জেলায় আন্দোলন শুরু করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। ভোটের আগে এই আন্দোলন ভাল ভাবে নিচ্ছে না শাসকদল।
যদিও আদিবাসী কুড়মি সমাজের মুখপাত্র অজিত মাহাতো বলেন, ‘‘এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যা মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে কিছু বলব না। তবে আমাদের দু’টি বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। প্রথমত, যাঁদের কুড়মি উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য করা হয়েছে, তাঁদের নিয়ে আপত্তি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজ্য সুপারিশ করলেই হবে না। রাজ্যের কালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে কুড়মি সম্প্রদায়কে এসটি তালিকাভুক্ত করার জন্য কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। সেই রিপোর্ট এমন হবে যাতে, সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন পাওয়া যায়। সে জন্য আগে সমাজ বিজ্ঞানী ও আমরা যাঁরা আন্দোলন করছি, তাঁদেরকে নিয়ে একটা কমিটি গড়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে সিআরআইকে রিপোর্ট দিতে হবে।’’
যদিও কুড়মি উন্নয়ন পর্ষদের সভাপতি সুনীল মাহাতো পাল্টা দাবি করেছেন, ‘‘উন্নয়ন পর্ষদের যাঁরা সদস্য হয়েছে, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। বহু অভিজ্ঞতা সম্পৃক্ত। ফলে এই ধরনের অভিযোগ তোলা অযৌক্তিক।’’