Narendra Modi Mamata Banerjee

কালকেই ভোট হলে দেখিয়ে দেব, কিন্তু বাংলার ভোট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন কি না দেখুন! মোদীকে বিঁধে চ্যালেঞ্জ মমতারও

বাংলায় আরও একটি পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে রাজ্যের পাঁচটি ‘সঙ্কট’ নিয়ে মমতার সরকারের সমালোচনা করেন মোদী। জবাব দিতে গিয়ে মমতা শুধু তা খণ্ডনই করেননি, উল্টে বিজেপির বিরুদ্ধেই ওই অভিযোগগুলি তুলেছেন।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ১৯:১৫
Share:

(বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের নির্ঘন্ট তৈরি হতে এখনও দেরি আছে। দেরি আছে ঘোষণাও। কিন্তু ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের যুযুধান দুই নেতানেত্রী বৃহস্পতিবারেই ‘নির্বাচনী যুদ্ধ‌’ শুরু করে দিলেন!

Advertisement

আলিপুরদুয়ারের সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনাধীন সরকারকে লক্ষ্য করে তোপ দেগেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই সভা শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই তাঁকে পাল্টা বিঁধতে ময়দানে নেমে পড়লেন মমতা। প্রসঙ্গত, মোদীর আক্রমণের পাল্টা যে তিনিই দেবেন, তা স্থির করেছিলেন মমতা নিজেই। ঘটনাপ্রবাহ তেমনই বলছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হতেই তৃণমূলের তরফে সংবাদমাধ্যমকে প্রথমে জানানো হয়েছিল, দলের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে মোদীর কথার জবাব দেওয়া হবে। কিন্তু খানিক ক্ষণের মধ্যেই ফের জানানো হয়, নবান্ন থেকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই সাংবাদিক বৈঠক করবেন। ফলে অন্য কোনও সাংবাদিক বৈঠক আর প্রাসঙ্গিক থাকবে না।

প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব দিতে যে মমতা নেমেছিলেন, তাঁকে দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ দেখিয়েছে। খানিক কড়া গলাতেই তিনি বলেন, ‘‘দেশের হয়ে বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা যখন বিদেশে গিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তখন আপনি এখানে রাজনীতি করতে এসেছেন? এটা রাজনীতি করার সময়? আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। পারলে কালকেই ভোট করুন। দেখিয়ে দেব।’’ প্রায় একনিঃশ্বাসে মমতা বলেন, ‘‘বাংলায় ভোট আসছে। কিন্তু তার এখনও দেরি আছে। তত দিন আপনি ক্ষমতায় থাকবেন কি থাকবেন না, সেটা আগে খেয়াল রাখুন। জেনে রাখুন, বাংলা কোনও দিন বিজেপির হাতে যাবে না!’’

Advertisement

সামগ্রিক ভাবে বিদেশনীতি নিয়ে বরাবর কেন্দ্রীয় সরকারের পাশেই থেকেছে তৃণমূল। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে বিদেশে গিয়েও সেই লাইনেই রোজ বক্তৃতা করছেন। বস্তুত, মমতা নিজের বক্তব্যে অভিষেকের নামও উল্লেখ করেন। কিন্তু সেই সঙ্গেই অভিযোগ করেন, সেনা অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ দেওয়া হয়েছিল রাজনীতি করার জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘সব নাম কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে। অপারেশন সিঁদুর নামটা দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক ভাবে ‘ক্যাচ’ করার জন্য। আমি এত দিন কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হলাম।’’

প্রধানমন্ত্রীর বৃহস্পতিবারের বক্তৃতার পরে তৃণমূল কি বহুদলীয় প্রতিনিধিদল থেকে তাদের প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেবে? জবাবে মমতা বলেন, ‘‘আমাদের পার্টি যত দিন থাকবে, তত দিন আমরা এই সব বিষয়ে দেশের সঙ্গেই থাকব। আমাদের প্রতিনিধিকে কেন ফিরিয়ে আনব? মোদীর উচিত বিদেশে যাওয়া।’’

কিন্তু পাশাপাশিই মমতা ও-ও স্পষ্ট করে দেন যে, আলিপুরদুয়ারের জনসভা থেকে মোদী যা যা বক্তব্য পেশ করেছেন, তা তাঁকে ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ করেছে। তার মাপ এতটাই যে, সিঁদুর প্রসঙ্গে মোদীকে আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত স্তরেও চলে গিয়েছিলেন মমতা। তবে সঙ্গে সঙ্গে তা শুধরেও নেন তিনি। মমতা বলেন, ‘‘অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। প্রত্যেক মহিলার সিঁদুরের প্রতি সম্মান রয়েছে। তাঁরা স্বামীদের থেকে সিঁদুর নেন। কিন্তু আপনি তো সকলের স্বামী নন! আপনি কেন আগে আপনার স্ত্রীকে সিঁদুর দেন না?” পরক্ষণেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি দুঃখিত। এটা আমার বলার কথা ছিল না। কিন্তু আপনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে বাধ্য করেছেন মুখ খুলতে!”

প্রসঙ্গত, ভারত-পাক সংঘাত পর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন, তিনিই মধ্যস্থতা করে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি করিয়েছেন দুই দেশকে। এ-ও জানিয়েছিলেন, দু’দেশকেই বলা হয়েছিল সংঘাত বন্ধ না-করলে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের সঙ্গে আমেরিকা বাণিজ্য বন্ধ করবে। সেই প্রসঙ্গ টেনে মোদীর উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘এত বড় নেতা আপনি, আমেরিকা বললেই তো চুপ হয়ে যান!’’ ভারত-পাক সংঘাতকে ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলে অভিহিত করে মমতা বলেন, ‘‘হয়েছে তো একটা ছোট্ট ঘটনা। কোনও যুদ্ধ তো হয়নি। আমরা যুদ্ধ চাই না।’’ তবে মমতা এ-ও বলেন যে, ‘‘যদি কারও কৃতিত্ব থাকে, তা হল ভারতীয় সেনার। অন্য কারও নয়।’’ কর্নেল সোফিয়া কুরেশির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কর্নেল কুরেশি বলেছেন, এই দেশটা সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ)। আমরা সকলে মিলে মাতৃভূমির জন্য লড়ছি। আর আপনি (মোদী) বাংলায় বিভাজনের কথা বললেন!’’

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বাংলায় পাঁচটি ‘সঙ্কট’-এর কথা বলেছেন। সেই তালিকায় রয়েছে হিংসা-অরাজকতা, মহিলাদের সম্মানহানি, বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং গরিবের অধিকার কেড়ে নেওয়া। নবান্ন থেকে এই পাঁচটি অভিযোগ মমতা শুধু খণ্ডনই করতে চাননি, পাল্টা বিজেপির বিরুদ্ধেই ওই অভিযোগগুলি করেছেন তিনি।

হিংসা এবং অরাজকতার কথা বলতে গিয়ে মোদী টেনে এনেছেন মুর্শিদাবাদ এবং মালদহে অশান্তির প্রসঙ্গ। অভিযোগ করেছেন পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার। মমতা পাল্টা বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদ, মালদহে যা হয়েছে তার পিছনে রয়েছে বিজেপি। ওরা অশান্তি করার মাস্টার। সব প্রমাণ আছে। দরকারে সংবাদমাধ্যমকে দেখিয়ে দেব।’’ মোদীর দ্বিতীয় অভিযোগ উড়িয়ে মমতা বলে দেন, দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাতেই মা-বোনেরা সুরক্ষিত। সেই প্রসঙ্গে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের একাধিক ঘটনার উদাহরণ দেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। মোদীর তৃতীয় ‘সঙ্কট’ বেকারত্বের অভিযোগ প্রসঙ্গে মমতা পাল্টা বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে আমরা ৪০ শতাংশ বেকারত্ব কমিয়েছি। আর তোমাদের ডবল ইঞ্জিন ৪০ শতাংশ বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।’’ দুর্নীতি প্রসঙ্গে জবাব দিতে গিয়ে মোদীকে মধ্যপ্রদেশে বিজেপির আমলে হওয়া ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা স্মরণ করান মমতা। পাশাপাশিই বলেন, ‘‘২৬ হাজারের চাকরি গিয়েছে কোর্টের নির্দেশে। আমাদের জন্য নয়। আর কোর্টে গিয়েছিল সিপিএম-বিজেপি।’’ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতকে নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও করেছেন মমতা। গরিবের অধিকারের কথা তুলে ধরতে বাংলায় সামাজিক প্রকল্পে উপভোক্তাদের পরিসংখ্যান দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘এত স্কিম (প্রকল্প) কোথাও নেই। এত মানুষ কোথাও সুবিধা পান না।’’ এই প্রসঙ্গেই মোদীর উদ্দেশে কটাক্ষ ছুড়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘এখানে আমিই অ্যাসেট, বাকি সব ক্যাসেট!’’

মমতার ৩৯ মিনিটের সাংবাদিক বৈঠকের প্রথম দু’মিনিট ছিল দুর্যোগ মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের প্রস্তুতির বর্ণনা। তার পরেই মোদীকে বেঁধা শুরু করেন ‘দিদি’। তৃণমূলনেত্রী সরাসরি অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী সিঁদুরের ‘রাজনৈতিক বিপণন’ করতে নেমেছেন। বুধবার পর্যন্ত তৃণমূলের ভাবনায় ছিল, অপারেশন সিঁদুর নিয়ে মোদী কিছু বললে তার পাল্টা কিছু বলা হবে না। কিন্তু সিঁদুরের সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে মোদীর বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম বার নির্বাচনের আগে বলেছিলেন উনি চা-ওয়ালা। তার পরের বার বললেন, পাহারাদার (চৌকিদার), আর এখন কি সিঁদুর বেচতে এসেছেন? মনে রাখবেন, সিঁদুর বেচা যায় না। এটা মা-বোনেদের আত্মসম্মান।’’

মমতার এ-ও অভিযোগ যে, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে মোদী সমস্ত রাজ্যে গিয়ে রাজনীতির কথা তুলে ভোটের কথাই বলছেন। কিন্তু মমতার পাল্টা তোপ, ‘‘বাংলা আপনার (কেন্দ্রীয় সরকারের) কাছে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা পায়। আগে সেই টাকা দিন। তার পরে কথা বলুন!’’

নীতি আয়োগের বৈঠকে মমতার অনুপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মোদী। জবাবে মমতা বলেন, ‘‘আগের বার বৈঠকে আমার মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এটা বাংলার মানুষকে অপমান নয়? আমি যদি কথাই বলতে না-পারি, তা হলে মুখ দেখাতে কেন যাব? মধ্যাহ্নভোজ খাওয়ার জন্য আমি কোথাও যাই না।’’ মোদীকে জবাব দিতে গিয়ে মমতা মেনুতে রেখেছিলেন আইপিএল ফাইনাল কলকাতা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গও। তাঁর কথায়, ‘‘নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম করেছেন আর সব খেলা ওখানে নিয়ে চলে যাচ্ছেন! আসল অঙ্ক কী? বলব? কী ভাবেন? আমি খেলার খবর রাখি না? সব খবর রাখি।’’

বছর ঘুরলে ভোট। ‘খেলা হবে’ স্লোগান এখন থেকেই দিয়ে রাখলেন মমতা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement