আসলে নরম, নকলে গরম

বিধানসভা তপ্ত খেলনা পিস্তল নিয়ে বিক্ষোভে

কান্দির মিছিলে কিছু নাইন এমএম। আর বড়বাজার থেকে ডজন ধরে কেনা প্লাস্টিকের কিছু খেলনা। এই দুই ধরনের পিস্তলকে কেন্দ্র করেই মুখ খুলে ফের বিতর্ক উস্কে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৪
Share:

খেলনা পিস্তল নিয়ে বিরোধী-বিক্ষোভ। মঙ্গলবার বিধানসভায়। —রণজিৎ নন্দী। (ডান দিকে) তৃণমূলের সমর্থকদের মিছিল। সোমবার কান্দিতে। — ফাইল চিত্র।

কান্দির মিছিলে কিছু নাইন এমএম। আর বড়বাজার থেকে ডজন ধরে কেনা প্লাস্টিকের কিছু খেলনা। এই দুই ধরনের পিস্তলকে কেন্দ্র করেই মুখ খুলে ফের বিতর্ক উস্কে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

Advertisement

রাজ্যে এখন যে আইনের শাসন প্রায় নেই বললেই চলে, শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকলে যে যা খুশি করে পার পেয়ে যেতে পারে— কান্দির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার বিধানসভায় এই প্রশ্নই ফের তুলেছে বিরোধীরা। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি তুলে ধরতে এবং কান্দির ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বাম বিধায়কেরা বিধানসভায় আসেন খেলনা পিস্তল হাতে। আর তাতেই ধুন্ধুমার বেঁধে গেল। অধিবেশনে হাজির হয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, বিধানসভার মধ্যে যাঁরা এ ভাবে বন্দুক হাতে বিক্ষোভ দেখালেন, তাঁদের গ্রেফতার করা উচিত! কিন্তু যে ঘটনার জেরে এত কিছু, কান্দির সেই ‘আসল’ পিস্তল-কাণ্ডে ফের সাজানো ঘটনার ছায়াই খুঁজে পেলেন মুখ্যমন্ত্রী!

পিস্তল-বিক্ষোভে বিধানসভা উত্তাল হয়ে ওঠার পরে এ দিন হঠাৎই সভায় এসে জিরো আওয়ারের পরে বিবৃতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে যেমন পিস্তল-বিক্ষোভের কড়া নিন্দা করেছেন, তেমনই আবার কান্দির ঘটনায় একটি চ্যানেলকে দোষারোপ করেছেন। প্রথমে অবশ্য তিনি বলেছেন, ‘‘মিছিলের খবর পেয়েই পুলিশকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত হচ্ছে।’’ কিন্তু এর পরেই যোগ করেছেন, ‘‘তবে একটা প্রাথমিক তথ্য পেয়েছি। কোনও একটা চ্যানেল টাকা দিয়ে মিছিলে লোক ঢুকিয়ে এ সব করেছে। প্ল্যান্টেড গেম হতে পারে! সত্যি হলে তাদের বিরুদ্ধেও কড়া অ্যাকশন হবে।’’

Advertisement

আসল হোক আর নকল, বিধানসভায় পিস্তল হাতে ঢোকা যে আজকের কঠোর নিরাপত্তার দিনে অভূতপূর্ব, সেটা অবশ্য কেউ কেউ মেনে নিলেন। পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, নকল পিস্তল নিয়ে এ ভাবে বিধানসভায় ঢোকাও মেনে নেওয়া যায় না। এ দিন বিধানসভায় পরিষদীয় মন্ত্রী হিসেবে প্রথমে পার্থবাবুই বিবৃতি দেন। তাঁর কথায় কিন্তু ‘সাজানো’ বা ‘চক্রান্তের’ ইঙ্গিত ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘‘যে দলের লোকেরাই থাকুক, যে পতাকাই হোক, আসল বা নকল হোক, গোটা বিষয়টির প্রশাসনের নির্দেশে তদন্ত হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন।’’ অথচ তার পরেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এসে এক দিকে ‘সাজানো খেলা’র তত্ত্ব হাজির করে এবং অন্য দিকে বাম বিধায়কদের নকল পিস্তল নিয়ে বিক্ষোভের জন্য গ্রেফতার করা উচিত বলে মন্তব্য করে ঘটনাপ্রবাহকে অন্য মাত্রা দিয়ে ফেলেছেন!

মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দেওয়ার পরেই তার রেশ ধরতে শুরু করেছেন তৃণমূলের অন্য নেতারাও। মুর্শিদাবাদের ভারপ্রাপ্ত তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী যেমন এ দিন বলেছেন, ‘‘সাংসদ হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বহরমপুরের একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক কংগ্রেসের সঙ্গে পরিকল্পনা করে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। সভার অনেক আগেই সভাস্থল থেকে অনেক দূরে একটি গলিপথে পরিকল্পিত ভাবে ছবি তুলে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে!’’ বিরোধীদের আশঙ্কা, সবং-কাণ্ডের মতো মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি ধরেই পুলিশ এ বার দ্রুত মামলা সাজিয়ে ফেলবে!

বিধানসভায় বিবৃতি দিয়ে নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আবার জানান, কান্দির ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনা হল, মুর্শিদাবাদের ভরতপুরে বাস থেকে নামিয়ে ইমরান শেখ ও গয়ানাথ কৈবর্ত্য নামে দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে ঠিকই। কিন্তু সোমবারের মিছিলে যাঁদের পিস্তল হাতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের নামধাম সংবাদমাধ্যমে বেরিয়ে গেলেও কেউ ধরা পড়েননি। ধৃত দু’জন মিছিলে ছিলেন। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে অন্তত তাঁদের বন্দুকধারীদের মধ্যে দেখা যায়নি। মুর্শিদাবাদের জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন ধৃতদের সঙ্গে দলের সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি এবং পুলিশের কাজ নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই সরব হয়েছে বিরোধীরা। তাদের প্রশ্ন, মিছিলে বন্দুকধারীরা এ ভাবে চিহ্নিত হওয়ার পরেও কেন তাঁরা অধরা? আর এই বিতর্ক থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই কি বিরোধীদের বিক্ষোভকে ‘নিষ্ঠুর ঘটনা’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হল? কান্দির কংগ্রেস বিধায়ক অপূর্ব সরকারের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলছেন তদন্ত চলছে। আবার তিনি বলছেন, একটা চ্যানেল লোক ঢুকিয়েছে! তা হলে আর তদন্তের দরকার কী!’’ বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরও মন্তব্য, ‘‘আসল পিস্তলের চেয়ে নকল পিস্তলেই রাজ্য সরকারকে বেশি উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে!’’

পিস্তল-কাণ্ডে সরকারের অবস্থান যাচাই করবেন বলেই এ দিন আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন বাম বিধায়কেরা। তাঁদের সঙ্গে কৌশলী সঙ্গত চালিয়েছে কংগ্রেসও। তবে তাদের আনা মুলতবি প্রস্তাব গ্রাহ্য হয়নি। আর বাম বিধায়কেরা অধিবেশন বসা মাত্রই খেলনা পিস্তল নিয়ে সভা উত্তাল করে তোলেন। মার্শালকে দিয়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অস্ত্র’ বাজেয়াপ্তও করেন! পার্থবাবু তাঁর বিবৃতিতে কান্দি কাণ্ডের তদন্তের আশ্বাসের পাশাপাশি বামেদের নবান্ন অভিযানের দিন পুলিশকে ইট মারার প্রসঙ্গ তোলায় ফের হইচই শুরু হয়। প্রবল বিক্ষোভের পরে বাম ও কংগ্রেস বিধায়কেরা ওয়াকআউট করে বেরিয়ে যান। আর তার পরেই বিরোধীশূন্য সভায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘‘বিধানসভায় এত বড় একটা নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটল। ভাগ্যিস এমন ঘটনার সময় সভায় ছিলাম না! এটা অসৌজন্য, অশোভনীয়ই শুধু নয়, গণতন্ত্রের কলঙ্কজনক দিন।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘নকল না আসল পিস্তল, পুলিশ তদন্ত করে দেখবে। স্পিকারকে ধন্যবাদ। উনি ওগুলো বাজেয়াপ্ত করেছেন। আমি মনে করি, যারা বন্দুক নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা উচিত!’’ তখন বামেদের গ্রেফতারের দাবিতে সরব তৃণমূল বিধায়কেরাও। যার প্রেক্ষিতে পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, ‘‘পিস্তল নিয়ে যারা মিছিল করল, তারা ধরা পড়ল না। আর আমাদের বিধায়কেরা খেলনা পিস্তল নিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করলেন বলে তাঁদের নাকি গ্রেফতার করতে হবে! উনি গ্রেফতার করে দেখান!’’

মুখ্যমন্ত্রী ওই কথা বলার আগেই অবশ্য বাম বিধায়কদের বিক্ষোভের জন্য তাঁদের তিরস্কার করে প্রস্তাব পাশ করা হয়ে গিয়েছে বিরোধীশূন্য সভায়। মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘নিয়ম অনুযায়ী, কোনও অস্ত্র নিয়ে বিধানসভায় প্রবেশ করা যায় না। এমনকী, লাঠি নিয়ে ঢুকতে গেলেও স্পিকারের অনুমোদন লাগে।’’ যা শুনে পরে সভার বাইরে সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমানের প্রশ্ন, ‘‘রাস্তায় কি আসল পিস্তল হাতে মিছিলের অধিকার আছে?’’

গোটা ঘটনাপ্রবাহে বিরোধীরা বারবার একটা প্রশ্নই তুলেছেন। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়ার কথায়, ‘‘নকল পিস্তলের প্রতিবাদ দেখে মুখ্যমন্ত্রী এত উদ্বিগ্ন। অথচ আসল অপরাধীরা চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ধরা পড়ছে না! কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে মুখ্যমন্ত্রীর তো উচিত আগে পুলিশ সুপারকে সাসপেন্ড করা!’’

খেলনা পিস্তল নিয়ে বিক্ষোভের জেরে প্রতিক্রিয়া যে আসল ঘটনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, নিজের বক্তব্যের শেষ পর্বে সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই শেষে তিনি বলেছেন, ‘‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারি, এরা যা করল, তার জন্য এদের ক্ষমা করে দাও!’’ সূর্যবাবু আবার পাল্টা বিঁধেছেন, ‘‘আমাদের জন্য ওঁকে ক্ষমা চাইতে হবে না! উনি সকলের জন্য একই আইন প্রয়োগ করে দেখান!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন