এক শহরের দুই বানান! ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
নামে কি আসে যায়? প্রশ্ন ছিল ইংরেজ লেখকের। আর যদি তর্ক জমে নামের বানান নিয়ে?
বীরভূমের জেলা সদর তথা শতাব্দী প্রাচীন শহর হল সিউড়ি। এই শহরের বানান নিয়েই যত গোল— ‘ড়’ এর পরে কোন বর্ণ যোগ হওয়া যথাযথ ‘ই’ নাকি ‘ঈ’কার?
সরকারি দফতরগুলির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে দু’ধরণের বানান। জেলা প্রশাসনিক ভবন, পুরভবন, শতাব্দী প্রাচীন জেলা স্কুল, গ্রন্থাগার থেকে শুরু করে বহু জায়গায় রয়েছে ‘সিউড়ী’ বানান। টেলি যোগাযোগ সংস্থার অফিস, পত্রপত্রিকা, বিভিন্ন দোকানপাটে শহরের বানান লেখা — ‘সিউড়ি’। গোল সেখানেই।
দু’ধরনের বানান দেখতে দেখতে শহরবাসী তো বটেই, বাইরে থেকে জেলা শহরে আসা মানুষ কোন বানান লিখবেন তা নিয়ে বিভ্রান্ত হন। দ্বন্দ্ব থেকে বাদ যায়নি সিউড়ি পুর কর্তৃপক্ষও। সম্প্রতি স্বচ্ছতা নিয়ে প্রকাশিত একটি লোগোতে পুরসভা ‘সিউড়ী’ বানান লিখেছে। সেই পুরসভাই আবার বিদ্যুতের খুঁটিতে দেওয়া বিজ্ঞাপনে লিখেছে সিউড়ি!
কোন বানান গ্রাহ্য হওয়া উচিত?
আধুনিক বানান বা সহজতম বানান লেখার দিকে যাঁদের ঝোঁক, তাঁরা বলছেন ‘সিউড়ি’। সহজ যুক্তিকে উড়িয়ে বিপক্ষ বলছেন, ‘‘সহজ করতে গিয়ে তো আর পুরনো বানানকে অস্বীকার করা যায় না!’’
তা হলে?
গৌরীহর মিত্রের ‘বীরভূমের ইতিহাস’ থেকে। (বানান অপরিবর্তিত)
গবেষকদের অনেকের মতে, এর উত্তর রয়েছে সিউড়ি নামের উৎপত্তির ইতিহাসে। শহরের বা জেলার ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেছেন অনেকেই। এঁদেরই এক জন গৌরীহর মিত্র। তিনি ‘বীরভূমের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখছেন ‘‘বীরভূমের রাজধানী সিউড়ী, শূরী (বা শৌর্য্যশালী) শব্দের অপভ্রংশ। তাই ইংরেজিতে সিউড়ি-র বানান শূরী (suri) লেখা হয়।’’ গৌরীহর মিত্র অন্য সম্ভবনার উল্লেখ করছেন। তিনি লিখেছেন, বীরভূমে এক সময় বৌদ্ধদের প্রভাব ছিল বলেই শিবাড়ী থেকে সিউড়ী হয়েছে। বীরভূমের ইতিহাস নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে অর্ণব মজুমদারের। প্রয়াত অর্ণববাবুর অবশ্য ভিন্ন মত। বইতে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘সিউড়ি নয়, শতাব্দী প্রচীন জনপদ হিসাবে বিখ্যাত ছিল সিউড়ির সন্নিকটস্থ কড়িধ্যা। প্রচুর সংখ্যক তন্তুবায়ী বা তাঁতি, শাঁখারি পরিবারের বাস ছিল কড়িধ্যায়। ছিলেন জমিদারেরাও। তার শিয়রে অর্থাৎ ঠিক উত্তর দিকে থাকা জনপদ সিউড়ির নাম ‘শিয়র’ থেকেই হয়েছে।’’ অর্থাৎ, সিউড়ি এবং সিউড়ী দু’রকমের বানানভেদ দেখা যাচ্ছে ইতিহাসবিদদের লেখা থেকে। ভাষা সাহিত্যের প্রয়াত অধ্যাপক তথা কবি কবিরুল ইসলাম সিউড়ি বানান লিখতেন শিউড়ি হিসাবে। শহরের ইতিহাস নিয়ে বই রয়েছে সুকুমার সিংহের। প্রবীণ সুকুমারবাবু অবশ্য তাঁর বইয়ে সর্বত্র ‘সিউড়ি’ বানানই লিখেছেন।
কোনটা সর্বজনগ্রাহ্য?
উত্তরের খোঁজে আসরে নেমেছেন ভাষাবিদেরাও। তাঁরা উপস্থিত করছেন নিজ নিজ ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। কেমন?
সিউড়ি জেলা স্কুলের বাংলার শিক্ষক চাঁদগোপাল দত্ত বলছেন, ‘‘সিউড়ির শেষে রয়েছে ‘ড়’ বর্ণটি। আমরা জানি ‘ড়’ উচ্চারণের সময়ে মূর্ধার ব্যবহার বেশি হয়। তাই এর সঙ্গে ঈ-কারই সহজে যায়। আমার মতে ‘সিউড়ী’-ই ঠিক বানান।’’ অর্ণব মজুমদারের ছেলে তথা সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক পার্থশঙ্খ মজুমদার বলছেন, ‘‘দেখুন কথা বলার সময় আমরা যখন ‘সিউড়ি’ শব্দটির উচ্চারণ করি, তখন তো সিউড়-ঈ-ঈ-ঈ বলি না! তা হলে শুধু শুধু ঈ লিখব কেন?’’ একই মত বীরভূমের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা বাংলার শিক্ষক আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের। বাংলা সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কিশোরীরঞ্জন দাস বিতর্কে না গিয়ে বলছেন, ‘‘আধুনিক বানানবিধি মানলে ই। আর পুরনো মতে গেলে ঈ।’’
ভাষাবিদ পবিত্র সরকার মনে করেন, তৎসম শব্দ না হওয়ার কারণে ‘সিউড়ি’ শব্দটি ই-কার দিয়ে লেখাই ভাল। তাঁর যুক্তি, ‘‘ঠিক একই কারণেই তো আমরা হুগলি, নৈহাটির মতো জায়গার নাম ই-কার দিয়ে লিখি।’’ আর বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের মত, ‘‘নামের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে ঈ-কারের ব্যবহার অপ্রচলিত নয়। তবে আধুনিক বানানবিধি অনুসারে ই-কার ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত। সেই কারণেই ‘সিউড়ি’।’’
এই তর্কের শেষ কোথায়?
শহরবাসীর জবাব, ‘‘আমাদের বিভ্রান্তি এড়াতে জেলা প্রশাসন বা পুরসভা কিছু একটা করুক?’’ কবে সেটা হয়, দেখার সেটাই।