সময় থাকতে আস্তাবলে আগল দেওয়া হয়নি। ঘোড়া পালানোর পরে এখন হা-হুতাশ! উত্তর মালদহের কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূরের দলবদল ঘিরে এখন অনেকটা এমনই দশা কংগ্রেসের!
ইঙ্গিত ছিল বহু দিন ধরে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পরে বোর্ড গঠনে শাসক দলকেই সমর্থন করার জন্য দলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মালদহ জেলা কংগ্রেস সভানেত্রী মৌসম। তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী সাফ বলেছিলেন, রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। প্রদেশ কংগ্রেসেরই দুই নেতা অনুপম ঘোষ ও ঋজু ঘোষাল মৌসমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে রাহুল গাঁধীকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। মৌসমের মুখের কথায় ‘বিশ্বাস’ করে তাঁদের যে মাসুল দিতে হয়েছে, এখন মানছেন কংগ্রেস নেতারা। ধাক্কা সামলে নতুন জেলা কংগ্রেস সভাপতির নামও এখনও ঘোষণা করতে পারেনি কংগ্রেস।
মালদহের দুই সাংসদ আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরী ও মৌসম, দু’জনকে নিয়েই জল্পনা বহু দিন ধরে। গত ডিসেম্বরে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে কংগ্রেসের সমাবেশে দাঁড়িয়ে ডালুবাবু ঘোষণা করেছিলেন, জেলার দুই আসনই তাঁরা রাহুলকে উপহার দেবেন। আর মৌসম বসেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে ‘অপপ্রচার’ চলছে। ভাগ্নী মৌসম তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে তাঁর ‘ডালুমামা’ বলছেন, ‘‘আমি তো অনেক বার কথা বলেছি। না জানিয়েই চলে গেল! ওর উপরে তৃণমূল খুব চাপ তৈরি করছিল। ওর বয়স কম, এই চাপ রাখতে পারেনি।’’ কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের তরফে আহমেদ পটেল চার দিন আগে মৌসমকে ফোন করেছিলেন। আহমেদকেও মৌসমের আশ্বাস ছিল, তিনি দল বদলাবেন না।
কিন্তু সব রকম ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও মাত্র চার দিন আগে নতুন কমিটি তৈরির সময়ে প্রদেশ কংগ্রেস মৌসমকেই জেলা সভানেত্রী পদে রেখে দিল কেন? অন্যান্য জেলায় কার্যকরী সভাপতি নিয়োগ করা হলেও মৌসমের ক্ষেত্রে বিকল্প কাউকে রাখা হল না কেন? প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘মৌসম বরকত গনি খানের পরিবারের সদস্য। যত বার কথা হয়েছে, বলেছেন অপপ্রচার চলছে। তিনি দলের নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন! শুধু তা-ই নয়, আজীবন জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী বরকতদা’র ঐতিহ্যকেও অপমান করা হল। মালদহের মানুষই ভবিষ্যতে এর জবাব দেবেন।’’ সোমেন-ডালুবাবুদের দাবি, মৌসমের সঙ্গে আর কেউ তৃণমূলে যাচ্ছেন না।
ভোট ঘোষণা হলে মৌসম তৃণমূলে যেতে পারেন, এই ধারণা থেকে উত্তর মালদহ কেন্দ্রের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ডালুবাবুর ছেলে ঈশা খান চৌধুরীর নাম অবশ্য ভেবে রেখেছিলেন সোমেনবাবুরা। মৌসম দলবদলের ঘোষণা করতেই কংগ্রেস পাল্টা ঈশার নাম ঘোষণা করে দিয়েছে। তবে জেলা সভাপতি হিসেবে এ বার সম্ভবত গনি পরিবারের বাইরে থেকে কাউকে বেছে নেওয়া হতে পারে, এমন ইঙ্গিত মিলছে কংগ্রেস সূত্রে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তৃণমূলের দিকেই তোপ ঘুরিয়ে দিচ্ছেন এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক গৌরব গগৈ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অমিত শাহ মালদহে এসে বলেছিলেন, কংগ্রেস ভেঙে গিয়েছে। কংগ্রেস ভাঙিয়ে তৃণমূল শাহের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে চাইল!’’ তৃণমূলের তরফে মালদহের পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীর অবশ্য পাল্টা দাবি, ‘‘দিল্লি আর বাংলার কংগ্রেসের লাইন আলাদা। রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা তৃণমূলের বিরুদ্ধেই বেশি কথা বলছেন। সাইনবোর্ড হয়ে যাওয়া দলের কথার জবাব দেওয়া অর্থহীন! মৌসম ঠিক কাজই করছেন।’’ আর স্বয়ং মৌসম বলছেন, ‘‘সব বিরোধী দলের নেতৃত্ব ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমর্থন জানিয়ে গিয়েছেন। তার পরেই বিজেপির মোকাবিলায় তৃণমূলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তবে কেন এত দিন ‘ধোঁয়াশা’ রেখেছিলেন, তার কোনও স্পষ্ট জবাব মেলেনি।
নতুন দলে গিয়ে এ দিনই মালদহে পৌঁছেছেন মৌসম। তৃণমূলের আশা, মালদহের দু’টি কেন্দ্র তো বটেই, পার্শ্ববর্তী রায়গঞ্জেও মৌসমকে কাজে লাগিয়ে ভোটে ফায়দা পাবে তারা।