ঢুকবে না পার্টির কাগজ

‘বেঁধে আনা’র ধ্বজা প্রেসিডেন্সি জেলেও

কর্তার চেয়ে কর্মচারী দড়! সব জমানায় ওঁরা আছেন। শাসকের নেকনজরে থাকার তাগিদে ধরে আনতে বললে যাঁরা বেঁধে আনতে সদা প্রস্তুত! এ হেন ‘অতিসক্রিয়তা’র জন্য বাম আমলে যেমন পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক অফিসারের দিকে আঙুল উঠেছে, তেমন বর্তমান আমলে একই অভিযোগ রয়েছে বেশ কিছু আমলা ও পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ ও অত্রি মিত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:১৭
Share:

কর্তার চেয়ে কর্মচারী দড়! সব জমানায় ওঁরা আছেন। শাসকের নেকনজরে থাকার তাগিদে ধরে আনতে বললে যাঁরা বেঁধে আনতে সদা প্রস্তুত!

Advertisement

এ হেন ‘অতিসক্রিয়তা’র জন্য বাম আমলে যেমন পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক অফিসারের দিকে আঙুল উঠেছে, তেমন বর্তমান আমলে একই অভিযোগ রয়েছে বেশ কিছু আমলা ও পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে। শাসকদলের সঙ্গে প্রকাশ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শিরোনামে এসেছেন শিক্ষাব্রতীও। এ বার তালিকায় জুড়ল রাজ্যের অন্যতম প্রধান সংশোধনাগারের কর্তৃপক্ষের নাম। অভিযোগ, কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলের সুপার সম্প্রতি জেলের ভিতরে সিপিএমের দলীয় মুখপত্র ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছেন! তাঁর ফতোয়া— ওটা পার্টির কাগজ। তাই কোনও বন্দি পড়তে পারবেন না। পয়সা দিয়ে কিনেও নয়।

এ সংক্রান্ত কোনও সরকারি নির্দেশ অবশ্য জারি হয়নি। স্বভাবতই জোর বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়েছে। বস্তুত রাজ্য প্রশাসনের একাংশে এই ধরনের প্রবণতা রীতিমতো ছোঁয়াচে হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে কিছু প্রবীণ অফিসারের মুখে। কী রকম?

Advertisement

বিস্তর উদাহরণ মজুত। যেমন বাম শাসনের শেষ লগ্নে অভিযোগ উঠেছিল, পশ্চিম মেদিনীপুরের এক পুলিশ অফিসার নিজেকে সরকারের বিশেষ ‘আস্থাভাজন’ প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। তাঁর নির্দেশে নিরীহ গ্রামবাসীদের ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে। আবার এই জমানায় বিরোধীদের দাবি, পশ্চিম মেদিনীপুরেরই এক পদস্থ পুলিশ অফিসার নবান্নের ‘গুড বুক’-এ থাকতে গিয়ে নিয়ম-নৈতিকতার ধার ধারছেন না। সরকারি মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘জঙ্গলমহলের মা’ সম্বোধনেও তিনি কসুর করছেন না। সরকারি নির্দেশ না-থাকলেও বিরোধীদের অনুমতি দিচ্ছেন না ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার চালানোর। পাশাপাশি সরকারি অনুষ্ঠান-মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর পা ছুঁয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শাসকদলের ডাকাবুকো নেতার মন রাখতে সরকারি হাসপাতালে পোষা কুকুরের ডায়ালিসিসের তোড়জোড় চলছে— এমন অভূতপূর্ব কাণ্ডও দেখা গিয়েছে।

প্রেসিডেন্সি জেলের কর্তৃপক্ষ এই ট্র্যাডিশনই বজায় রেখেছেন বলে অভিযোগ। কারা-সূত্রের খবর: ওখানে আপাতত শুধু এক জন কয়েদি সিপিএমের মুখপত্র পড়েন। তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের ডাকসাইটে সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডে। নেতাই-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত অনুজবাবুকে জেল-কর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, অন্য সব কাগজ পড়া যাবে, শুধু পার্টির কাগজটি বাদে। রাজ্যের সব জেলেই কি এক নিয়ম?

কারা দফতর বলছে, একেবারেই নয়। সংশ্লিষ্ট কাগজটির পাঠক মোটামুটি সব জেলে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সংশোধনাগার আইনের ৩৬ (২) ধারা অনুযায়ী, জেল সুপার যে কোনও বন্দিকে একটি কাগজ কেনার অনুমতি দিতে পারেন। অথবা পরিজনেরা তাঁকে কাগজ পাঠাতে পারেন। আইন মোতাবেক, নিষিদ্ধ হয়ে না থাকলে, সমাজবিরোধী কার্যকলাপে প্রশ্রয় না-দিলে, কিংবা পাঠকের নৈতিক অধঃপতন হয়, এমন লেখা না-ছাপলে সেই কাগজ পড়তে বাধা নেই। এবং সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা করাটা আইনের চোখে মোটেই সমাজবিরোধী কাজ নয়।

এমতাবস্থায় সিপিএমের দলীয় মুখপত্রে ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারির খবর শুনে ভুরু কুঁচকোচ্ছে কারা-কর্তাদেরই অনেকের। কেন এই সিদ্ধান্ত?

প্রেসিডেন্সি জেলের সুপার অরিন্দম সরকার মন্তব্য করতে নারাজ। জেলের এক অফিসারের অবশ্য যুক্তি, ‘‘কোনও পার্টির মুখপত্র বন্দিদের পড়তে দেওয়া যায় নাকি!’’ তবে ব্যাপারটা নিয়ে যখন কথা উঠেছে, তখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কারা দফতরের ডিজি অরুণ গুপ্ত বলেছেন, ‘‘এত খুঁটিনাটি বিষয় জানা আমার কাজ নয়। আমি কিছু জানিও না।’’

কর্তারা ‘না-জানলেও’ তোপ দাগতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ কঙ্কাল-কাণ্ডে বেশ কিছু দিন জেলে ছিলেন। আলিপুর জেলে থাকাকালীন তিনি নিয়মিত দলীয় মুখপত্র পড়তেন। কোনও অসুবিধে হয়নি। ‘‘অনেক কাগজই কিনে পড়েছি। কেউ আটকায়নি। কে কী কাগজ পড়বে, তা-ও সরকার ঠিক করে দিলে নিন্দার ভাষা নেই।’’— মন্তব্য সুশান্তবাবুর।

ঘটনাটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম নিদর্শন হিসেবে দেখছেন সুশান্তবাবুরা। অস্বস্তির ছোঁয়া নবান্নের অন্দরেও। আমলাদের কারও কারও মতে, এক শ্রেণির অফিসারের এই জাতীয় ‘বাড়াবাড়ি’র কারণে আদতে সরকারেরই মুখ পুড়ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন